ফ্ল্যাটের মালিক জানেন না তার ফ্ল্যাটটি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ভুয়া মালিক সেজে যার কাছে ফ্ল্যাটটি বিক্রি করা হচ্ছে সেই ক্রেতাও ফ্ল্যাটটির মালিকানা এবং দখলস্বত্ব কখনও বুঝে নিতে চাইবেন না। বেচাকেনার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অর্থ লেনদেনও হবে না। কারণ একজন ভুয়া মালিক সেজে ফ্ল্যাট বিক্রি করছেন, আরেকজন ভুয়া ক্রেতা সেজে কিনছেন। ভুয়া মালিক ও ক্রেতা সেজে তারা ফ্ল্যাট বেচাকেনার সব ধরনের কাগজপত্রও তৈরি করছেন।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ঢাকা রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে এমনই একটি নতুন জালিয়াত চক্র ধরা পড়েছে গত সোমবার।
সূত্র জানায়, তাদের মূল লক্ষ্য একটাই, ওইসব ভুয়া কাগজপত্র ব্যাংকে জমা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার কথা বলে ঋণের নামে টাকা তুলে আত্মসাৎ করা। গত সোমবার ওয়ান ব্যাংকে ফ্ল্যাট কেনার নামে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে ৮৫ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার আগ মুহূর্তে ধরা পড়েছেন ওই চক্রের তিন সদস্য।
সরেজমিন জানা গেছে, চক্রের সদস্যরা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ঢাকার মুগদা থানার পূর্ব ব্রাহ্মণচিরণ মৌজার ২১১৬ দাগের ৯ তলা ভবনের সাত তলার একটি ফ্ল্যাট কেনার রেজিস্ট্রেশন করতে গত সোমবার শ্যামপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যান। ওই অফিসটি তেজগাঁওয়ের ঢাকা রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে অবস্থিত। ফ্ল্যাটের নাম জারির কাগজে মতিঝিল সার্কেলের এসি ল্যান্ডের স্বাক্ষর ও বিক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে সন্দেহ হয় শ্যামপুরের সাব-রেজিস্ট্রার খালিদ মোহাম্মদ বিন আসাদের। পরে তিনি কাগজপত্রসহ বিক্রেতা, ক্রেতা ও শনাক্তকারীকে সঙ্গে নিয়ে এর সমাধানের জন্য যান কমপ্লেক্সের চার তলায় ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকারের কাছে।
জেলা রেজিস্ট্রার ওইসব কাগজপত্র দেখে ও ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে তাদের জালিয়াত চক্রের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। জেলা রেজিস্ট্রারের কক্ষেই প্রাথমিকভাবে আটক করে তাদের মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। ওই সময় চক্রের সদস্যদের মাধ্যমেই ফ্ল্যাট কেনার নামে ওয়ান ব্যাংকের কারওয়ানবাজার শাখার ৮৫ লাখ টাকার ঋণের মঞ্জুরিপত্র সংগ্রহ করা হয়। এরপর জেলা রেজিস্ট্রার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি আবদুর রশিদকে ফোনে বিষয়টি জানিয়ে পুলিশ পাঠাতে অনুরোধ করেন। পরে পুলিশ উপস্থিত হলে জালিয়াত চক্রের সদস্যদের সোপর্দ করা হয়। এরপর ভুয়া ফ্ল্যাট ক্রেতা-বিক্রেতা ও বিক্রেতা শনাক্তকারীসহ চার জনকে আসামি করে শিল্পাঞ্চল থানায় জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে মামলা করা হয়।
ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার সমকালকে বলেন, প্রতিনিয়ত নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে আমাদের। কমপ্লেক্সে রেকর্ডস অব রাইটস (আরওআর) নেই। নাম জারির পর এসি ল্যান্ড অফিস থেকে কোনো কপি দেওয়া হয় না। জাতীয় পরিচয়পত্র পরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই। এসব কারণে জালিয়াত চক্র চোখে ধুলা দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তিনি বলেন, জালিয়াতি ও প্রতারণা বন্ধে কমপ্লেক্সে ওইসব সুবিধা থাকা জরুরি।
জেলা রেজিস্ট্রার আরও বলেন, জালিয়াতি, প্রতারণা ও দুর্নীতি বন্ধে সদিচ্ছা থাকলে সরকারের যে কোনো কর্মকর্তা, যে কোনো প্রতিষ্ঠান, যে কোনো সময় কঠোর ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনে সরকারিভাবে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শ্যামপুরের সাব-রেজিস্ট্রারের সদিচ্ছার কারণেই ফ্ল্যাট জালিয়াত চক্রকে ধরা সম্ভব হয়েছে।
মুগদা থানার পূর্ব ব্রাহ্মণচিরণ মৌজার ২১১৬ দাগের ৯ তলা ভবনের সাত তলার ফ্ল্যাটের প্রকৃত মালিক আবু তাহের হোসেন খান। ছিমছাম গোছের সরল প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় ওই ফ্ল্যাটের ওপর কুনজর পড়ে জালিয়াত চক্রের সদস্য আবদুল্লাহ আল হোসাইন পারভেজের। তিনি ওই ফ্ল্যাটের ভুয়া মালিক হওয়ার জন্য আবু তাহের হোসেন খান নামে ছবিসহ অন্যান্য তথ্য ব্যবহার করে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। এরপর চক্রের আরেক সদস্য আবদুল্লাহ শাহরিয়ার রোদোয়ানকে ক্রেতা সাজানো হয়। ফ্ল্যাটের মালিক বা বিক্রেতাকে শনাক্তকারি বানানো হয় চক্রের অপর সদস্য সামছুল আলমকে। দলিল লেখক হিসেবে নিযুক্ত করা হয় অ্যাডভোকেট এ এম শাহাবউদ্দিন শিহাবকে।
শ্যামপুরের সাব-রেজিস্ট্রার খালিদ মোহাম্মদ বিন আসাদ বাদী হয়ে সোমবার শিল্পাঞ্চল থানায় ওই চারজনকে আসামি করে মামলাটি করেছেন। এর মধ্যে আবদুল্লাহ আল হোসাইন পারভেজ, আবদুল্লাহ শাহরিয়ার রোদোয়ান ও সামছুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি আবদুর রশিদ সমকালকে বলেন, মঙ্গলবার গ্রেফতার তিনজনকে আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলাটি তদন্ত করছেন সাব-ইন্সপেক্টর রুহুল আমীন।
সূত্র জানায়, ফ্ল্যাটটি ৪৫ লাখ টাকায় কেনাবেচার ভুয়া কাগজও তৈরি করেছে ওই চক্র। ভুয়া ক্রেতা আবদুল্লাহ শাহরিয়ার রোদোয়ান ওয়ান ব্যাংকের কারওয়ানবাজার শাখায় ওইসব কাগজপত্র জমা দিয়ে ৮৫ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করান। তাদের ওই জাল-জালিয়াতির মূল উদ্দেশ্য ছিল জাল কাগজপত্রে (ওয়ান মঞ্জুরি স্মারক নম্বর- ওবিএল/ আরবিডি/ এইচএল/ ৫৮৪৪/ ২৫৫৯/ ২০১৯) ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা তুলে আত্মসাৎ করা। তারা তাদের টার্গেটের খুব কাছাকাছি পৌঁছার পর হঠাৎই ধরা পড়ে যান। বেরিয়ে আসে ফ্ল্যাট কেনাবেচায় নতুন জালিয়াত চক্র।