গণশুনানিতে ভোট ‘কারচুপির প্রমাণ’ দিতে এসে নেতাদের জবাবদিহি চেয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থীরা। তারা জানতে চান, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে হামলা, মামলায় প্রার্থীরা ভোটের মাঠে দাঁড়াতে না পারলেও কেন কর্মসূচি দেওয়া হয়নি। ভোটের আগের রাতে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে নৌকায় সিল মেরে বাক্স ভরা হলেও কেন আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়নি।
প্রার্থীরা বলেন, এক বছরের বেশি খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলেও তার মুক্তির দাবিতে বিএনপি কেন কঠোর আন্দোলনে যাচ্ছে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে দাবিতে আবেদন-নিবেদনের পথ ছেড়ে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়ার দাবি জানান প্রার্থীরা।
শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ‘অনিয়ম, কারচুপি’ তুলে ধরতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানিতে এসব কথা বলেন ধানের শীষের প্রার্থীরা। এতে ৪১ জন প্রার্থী তাদের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। কয়েকজন ‘কারচুপির প্রমাণ’ লিখিত আকারে জমা দেন। নির্বাচনে নির্যাতনের শিকার দুই এজেন্ট তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানান।
গণশুনানিতে প্রায় সব প্রার্থীর অভিযোগ ছিল- ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নয়, তাদের প্রতিপক্ষ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আট ঘণ্টার শুনানি শেষে ‘বিচারক প্যানেলের’ সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, প্রার্থীদের বক্তব্যে পরিস্কার, ৩০ ডিসেম্বর কোনো নির্বাচনই হয়নি, যা হয়েছে তাকে নির্বাচন বলা যাবে না। একে বলা যেতে পারে সরকারের প্রহসন। দেশের নাগরিককে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, সংবিধান অমান্য করা হয়েছে, গণতন্ত্রের মূলনীতিকে অবমাননা করা হয়েছে।
সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে গণশুনানি। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে গণশুনানির ‘বিচারক প্যানেলে’ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাবেক বিচারক আ ক ম আনিসুর রহমান খান ও আইনজীবী মহসিন রশিদ।
গণশুনানির শুরুতে চকবাজারে আগুনে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
গণশুনানিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ প্রায় সবাই ছিলেন অনুপস্থিত। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকরা অংশ নিলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ জোটের দলগুলোর অধিকাংশ ছিল না। এলডিপি, বিজেপি, জমিয়ত, খেলাফত মজলিস, কল্যাণ পার্টি, পিপিবির প্রার্থীরা ধানের শীষে ভোট করলেও তাদের কেউ গণশুনানিতে আসেননি।
লালমনিরহাট-৩ আসনের আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, তার নির্বাচনী এলাকার সাতটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। মৃত ব্যক্তিরাও ভোট দিয়েছেন। ২৩টি কেন্দ্রে ৯৫ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে। নির্বাচন ৩০ তারিখ হয়নি, হয়েছে আগের রাতেই। তার কাছে এর ভিডিও ক্লিপও রয়েছে। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা ব্যবস্থা নেননি।
সাতক্ষীরা-১ আসনে দু’বারের এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিব বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সাতটি কেন্দ্রে তিনি শূন্য ভোট পেয়েছেন।
টাঙ্গাইল-৮ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী বলেন, নির্বাচন ছিল ৩০ ডিসেম্বর। কিন্তু ভোট হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর।
যশোর-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, তার ওপর তিন দফা বোমা হামলা, গুলি-বর্ষণ ও গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। ২০ থেকে ২৯ ডিসেম্বর তার এলাকায় এক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১৩টি গায়েবি মামলা হয়। তার প্রধান এজেন্টকে পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়।
হবিগঞ্জ-১ আসনের রেজা কিবরিয়া বলেন, ভোটের আগেই মিথ্যা তার কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার করা হয়। নির্বাচনের দেড় মাস তারা বাড়িতে থাকতে পারেননি। বিএনপির এক নেতাকে বাড়িতে না পেয়ে তার ১৬ বছরের ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
গাজীপুর-৩ আসনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, তার নিজের নামে স্কুলে যে কেন্দ্র রয়েছে, সেখানকার সিসি ক্যামেরা রিটার্নিং কর্মকর্তা খুলে ফেলেন।
ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীর এক এজেন্ট সোনিয়া আখতার বলেন, ভোটের দিন সকালে ওয়ারীর একটি কেন্দ্রে পুলিশের সামনে তার ওপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। তিনি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। মাটিতে পড়ে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। সোনিয়ার বক্তব্য শুনে দর্শক সারিতে বসা মির্জা ফখরুল ইসলাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাকে চোখ মুছতে দেখা যায়।
গণশুনানিতে সিরাজগঞ্জে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়া মেরি বেগম তার ওপর হামলার ঘটনা তুলে ধরলে পুরো মিলনায়তনের প্রার্থী-সমর্থকরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মঞ্চে বসা ড. কামাল হোসেনসহ অন্যদের অশ্রুসজল দেখাচ্ছিল। মেরি বেগম বলেন, ১৪ ডিসেম্বর পুলিশ তাকে গুলি করবে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। চোখ হারানোর চেয়েও তার বড় দুঃখ ৩০ তারিখে ভোট দিতে পারেননি। ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি ভোট দিতে চাই, আমাকে ভোট দিতে দেন, নইলে আমার দুই চোখ ফেরত দেন।’
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের প্রার্থী জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের প্রধান এজেন্ট ও তার স্ত্রী তানিয়া রব বলেন, ৩০ ডিসেম্বর নাগরিকরা ভোট দিতে না পেরে অপমানিত হয়েছেন।
কুমিল্লা-১০ আসনের প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, এবারের নির্বাচনে ধানের শীষের পক্ষে যেমন গণজোয়ার ছিল তা সত্তরের নির্বাচনে নৌকার পক্ষেও ছিল না। এত সমর্থনের পরও বিএনপি কেন সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে তার জবাবদিহি করতে হবে।
নোয়াখালী-২ আসনের প্রার্থী জয়নুল আবদিন ফারুক প্রশ্ন তোলেন, কেন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন হলো না। দলের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি ভোটে অংশ নিয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের কোনো কর্মসূচিই দেওয়া হয়নি। মওদুদ আহমদ প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সব প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের সামনে অবস্থান নিলে সরকারের কারচুপির বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে আওয়াজ উঠবে। এ প্রস্তাব কেন গ্রহণ করা হয়নি, তা জানতে চান ফারুক।
পিরোজপুর-৩ আসনের প্রার্থী রুহুল আমিন দয়াল বলেন, ৩০ ডিসেম্বর মহাজালিয়াতির নির্বাচনের পরও বিএনপি কেন আন্দোলনে যায়নি। দর্শক সারি থেকে এ সময় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এসব আত্মসমালোচনা দলীয় ফোরামে করা উচিত, গণশুনানিতে নয়।’
গণশুনানির শুরুতে ড. কামাল হোসেন বলেন, তারা বিচারক নন। বিচার করার ক্ষমতা তাদের নেই। বিচার হবে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে। গণশুনানিতে যে বক্তব্য আসবে, তা পরবর্তী সময়ে বই আকারে প্রকাশ করার কথা জানান তিনি।
গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
প্রার্থীদের গণশুনানিতে আরও অংশ নেন গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী (ঢাকা-৬), মোস্তফা মহসিন মন্টু (ঢাকা-৭), মাহমুদুল ইসলাম রুবেল (শেরপুর-৩), নিতাই রায় চৌধুরী (মাগুরা-২), মিজানুর রহমান মিনু (রাজশাহী-২), হাবিবুর রহমান হাবিব (পাবনা-৪), খায়রুল কবীর খোকন (নরসিংদী-১), শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী (লক্ষ্মীপুর-৩), রুমানা মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সাবিনা ইয়াসমীন ছবি (নাটোর-২), আনিসুর রহমান তালুকদার (মাদারীপুর-৩), আবুল হোসেন খান (বরিশাল-৬), ডা. শাহাদাত হোসেন (চট্টগ্রাম-৯), শামা ওবায়েদ (ফরিদপুর-২), সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল (নরসিংদী-৪), নুরুল ইসলাম আজাদ (নারায়ণগঞ্জ-২), হাবিবুল ইসলাম হাবিব (সাতক্ষীরা-১), আখতারুজ্জামান মিয়া (দিনাজপুর-৪), সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক (ঢাকা-১৪), শাহজাহান চৌধুরী (কক্সবাজার-৪), শাহ মো. ওয়ারেছ আলী মামুন (জামালপুর-৫), সাইফুল ইসলাম ফিরোজ (ঝিনাইদহ-৪), সাইফুল ইসলাম (রংপুর-৬) জেএসডির সাইফুল ইসলাম (কিশোরগঞ্জ-৩), অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (পাবনা-১), নাগরিক ঐক্যের এসএম আকরাম (নারায়ণগঞ্জ-৫), নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর (বরিশাল-৪), লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান (পিরোজপুর-২), জাতীয় পার্টির (জাফর) আহসান হাবিব লিংকন (কুষ্টিয়া-২)। নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেও পরে আদালতের রায়ে বাদ পড়া খোন্দকার আবু আশফাকও (ঢাকা-১) বক্তব্য দেন।