প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বর্ধিতকরণ প্রকল্পের দরপত্র পর্যায়েই অনিয়মের পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সরকারের কেন্দ্রীয় ক্রয়-সংক্রান্ত টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত বিধিমালা এবং আন্তর্জাতিক দরপত্র সংক্রান্ত গাইডলাইন লঙ্ঘন করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এর ফলে বিমানবন্দর নির্মাণে বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করা কোম্পানিগুলোর দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
২০১৭ সালে এ প্রকল্প নেওয়া হয়। এরপর থেকেই জাপানের একটি কোম্পানি এ কাজ পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। বিমানবন্দর অবকাঠামো নির্মাণে এক সময় এ কোম্পানির খ্যাতি থাকলেও বর্তমানে সেটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে। এর পরও এ কোম্পানিকে এ কাজটি পাইয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবেই দরপত্রে কিছু অদ্ভুত শর্ত যোগ করা হয়েছে। সিপিটিইউয়ের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দরপত্রের এই শর্তগুলোই অনিয়ম।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান এ ব্যাপারে সমকালকে বলেন, বেবিচক মনে করছে সিপিটিইউয়ের পর্যবেক্ষণ যথাযথ নয়। পর্যবেক্ষণটি পাওয়ার পর সেটির জবাব দেওয়া হয়েছে। দরপত্রের শর্ত নির্ধারণ এবং প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বেবিচক যথাযথ নীতিমালা ও বিধি অনুসরণ করছে বলে জানান তিনি।
যে কারণে প্রকল্প :হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে অত্যাধুনিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে গৃহীত এ প্রকল্পের মাধ্যমে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মিত হবে। এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে এ বিমানবন্দরে প্রায় দুই কোটি যাত্রীর সেবা সক্ষমতা নিশ্চিত হবে। নিরাপত্তা ও অন্যান্য সেবার অবকাঠামো শীর্ষ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যায়ে উন্নীত করাও সম্ভব হবে। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৬১৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১১ হাজার ২১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা আসবে জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাইকার ঋণ থেকে। বাকি টাকার জোগান দেওয়া হবে সরকারি তহবিল থেকে। প্রকল্পটির তত্ত্বাবধানে রয়েছে বেবিচক।
এ প্রকল্পের আওতায় তৃতীয় টার্মিনালের আয়তন হবে প্রায় দুই লাখ ২৬ হাজার বর্গমিটার। এ ছাড়া বর্ধিতাংশে ৯৮ হাজার ৫০০ বর্গমিটারের ‘উড়োজাহাজ পার্কিং অ্যাপ্রোন’ এলাকা, ৬৬ হাজার ৫০০ বর্গমিটারের ট্যাক্সিওয়ে এবং ৬২ হাজার বর্গমিটারের কার পার্কিং এলাকা থাকবে। এর বাইরে থাকবে পাঁচ হাজার ৯০ বর্গমিটারের ভিভিআইপি কমপ্লেক্স এবং এক হাজার ৮২০ বর্গমিটারের রেসকিউ এবং ফায়ার ফাইটিং সুবিধা। এতে এ বিমানবন্দর আমূল পাল্টে যাবে। চলতি বছরের জুনে শুরু করে ২০২২ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পের দরপত্র খোলা হবে ১৯ মার্চ।
দরপত্রের শর্তাবলি : এ প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। কিন্তু এর পরও বিশ্বের একাধিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবকাঠামো নির্মাণ করতে এসে বিভিন্ন শর্তের কারণে দরপত্র কিনতেই পারেনি। এ নিয়ে সরকারের ক্রয়-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) অভিযোগ জমা দেয় তুরস্কের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গ্যাপ-ইনসাত। কাতারের দোহা, সংযুক্ত আরবের আবুধাবি ও দুবাই, তুরস্কের ইস্তাম্বুল, সৌদি আরবের রিয়াদ এবং নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বিমানবন্দরের অবকাঠামো নির্মাণে লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাডি গ্রুপের তালিকায় এক নম্বরে অবস্থান করছে।
গ্যাপ-ইনসাত অভিযোগ করেছে, বেবিচক তাদের কাছে দরপত্র বিক্রিতে রাজিই হয়নি। এ অভিযোগ পর্যালোচনা করে গত ১৮ অক্টোবর সিপিটিইউ থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয় বেবিচককে। চিঠিতে বলা হয়, কোনো পূর্বশর্ত দিয়ে দরপত্র বিক্রি করা বিধিসম্মত নয়। দরপত্রের কয়েকটি শর্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র নীতিমালা এবং সরকারি ক্রমবিধির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ কারণে এসব শর্ত সংশোধনের জন্য বলা হয়। সিপিটিইউ থেকে এ চিঠি পাওয়ার পর গ্যাপ-ইনসাতের কাছে দরপত্র বিক্রি করে বেবিচক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৩১ জানুয়ারি আবারও বেবিচকের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে সিপিটিইউ। উপ-পরিচালক মাহফুজার রহমান স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে সুনির্দিষ্টভাবে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয় যে, এর আগে যেসব অপ্রয়োজনীয় শর্ত পরিবর্তনের জন্য বলা হয়েছিল, দরপত্রের সঙ্গে সেগুলো এখনও থেকে গেছে। চিঠিতে এসব শর্ত আবারও সংশোধন করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, যে কোনো প্রকল্পের দরপত্রের শর্ত তৈরিতে সরকারি ক্রয়বিধি এবং প্রকল্পের ঋণ দাতা সংস্থার নীতিমালা অনুসরণ করা হয়ে থাকে। বেবিচকের এ প্রকল্পের দরপত্রে এক্ষেত্রে স্পষ্ট ব্যত্যয় দেখা গেছে। এর ফলে দরপত্রটি প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, দরপত্রের শর্তে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা সনদের ক্ষেত্রে ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসের আগের আইএসও সনদ ১৪০০১ থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকারি ক্রয়বিধি এবং দাতা সংস্থা জাইকার নীতিমালা অনুযায়ী এ ধরনের শর্ত আরোপের সুযোগ নেই। দরপত্রের শর্তে কোন প্রতিষ্ঠানের কত বেশি হালনাগাদ সনদ আছে সেটাই প্রযোজ্য ও বিবেচ্য।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বর্তমানে আইএসও সনদের আরও উন্নত স্তর স্থাপিত হয়েছে। আইএসও সনদের স্তর ৪৫০০১ :২০১৮ পর্যন্ত এসেছে। কেন বেবিচকের দরপত্রে উন্নত স্তরের আইএসও সনদের পরিবর্তে ১৪ বছর আগের সনদ শর্ত হিসেবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়।
আরেকটি শর্তে সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এর আগে জাইকার ঋণের প্রকল্পে এবং জি-৭ দেশে কাজের অভিজ্ঞতার শর্ত দেওয়া হয়েছে। সিপিটিইউয়ের চিঠিতে জাইকার গাইডলাইনে এ ধরনের কোনো শর্তের বিষয় নেই জানিয়ে বলা হয়, কত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা আছে, কতটি দেশে আছে এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কতটা উন্নত সক্ষমতার প্রমাণ রয়েছে তা বিবেচনায় আসবে। বেবিচকের দরপত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় না এনে যোগ্যতার শর্তকে সংকুচিত হয়েছে। এর ফলে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর দরপত্রে অংশগ্রহণ এখনও অনিশ্চিত।
জাইকার অবস্থান : জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা সংস্থা জাইকা-সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটি এ বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থের জোগান দিচ্ছে। দাতা সংস্থা হিসেবে জাইকা দরপত্রের জন্য শুধু একটি গাইডলাইন দিয়েছে। এর বাইরে দরপত্র প্রক্রিয়ায় আর কোনোভাবে ভূমিকা রাখছে না। কোন দেশের কোম্পানি কাজ পাচ্ছে, তাও জাইকার দেখার বিষয় নয়। এমনকি জাপানের কোনো কোম্পানিকে কাজ দিতে হবে জাইকার এমন কোনো শর্তও নেই। ফলে দরপত্র-সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার। তবে জাইকা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতি নিজস্ব প্রক্রিয়ায় নজর রাখে। অনিয়ম এবং দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ উঠলে জাইকা নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়।
এর আগে ২০১৫ সালের মে মাসে বিটিসিএলের একটি বড় প্রকল্পে অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর জাইকা প্রায় ২০০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।