প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের প্রেরণা হিসেবে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে। বিশ্বের সব নিপীড়িত-শোষিত ও বঞ্চিত মানুষকে প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে এ ভাষণ, আগামীতেও দিয়ে যাবে। ৪৮ বছর হয়ে গেলেও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের আবেদন এখনও সামান্যও কমে যায়নি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বলেছিলেন- ‘বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ সত্যিই, বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না। যুগের পর যুগ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পুরো জাতিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দেশপ্রেম, ত্যাগ ও আদর্শের মহিমায় উজ্জীবিত করে তুলছে। যারা ৭ মার্চের ভাষণকে নিষিদ্ধ করেছিল, তারা ধীরে ধীরে আঁস্তাকুড়ের দিকেই চলে যাবে, নিঃশেষ হয়ে যাবে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। দিনটি উপলক্ষে এর আগে সকালে ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী। দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারাদেশে দিবসটি পালিত হয়।
আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পৃথিবীতে অনেক শ্রেষ্ঠ ভাষণ আছে। কিন্তু গত ৪৮ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মতো আর কোনো ভাষণ এতবার বাজেনি। তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ, এটি এখন প্রমাণিত সত্য।
তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক বড় বড় নেতা অনেক ভাষণ দিয়েছেন। গত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে এসব শ্রেষ্ঠ ভাষণ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় যে শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলো স্থান পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি। সে কারণে জাতিসংঘের ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৪৮ বছর ধরে কতবার, কত সময়, এই ভাষণটি বাজানো হয়েছে, কত মানুষ শুনেছেন তার হিসাব রাখা অসম্ভব। পৃথিবীর অন্য কোনো নেতার ভাষণ এতবার বাজানোর ইতিহাস নেই। বিশ্বের বড় বড় নেতার ভাষণগুলো একবার বেজেই থেমে গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি যুগ যুগ ধরে বেজেই যাচ্ছে। দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক শ্রেষ্ঠ ভাষণ আছে, যেগুলো ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল সম্পূর্ণ অলিখিত, কোনো নোট পর্যন্ত ছিল না। বঙ্গবন্ধু যা বিশ্বাস করতেন, তার সেই মনের কথাই এই ভাষণে বলে গেছেন তিনি।
তিনি বলেন, জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ একেকটি কোটেশন হয়। ভাষণের প্রতিটি লাইন, শব্দ বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের অনুপ্রেরণা জোগাতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি আজীবন টিকে থাকবে।
বক্তব্যের শুরুতে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্যসহ এই ভাষণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর এই ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। যেহেতু পাকিস্তানি হানাদারদের এই ভাষণটি পছন্দ নয়, সে জন্য ক্ষমতা দখল করে এই ভাষণটি বাজানো নিষিদ্ধ করেছিলেন ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে সামরিক স্বৈরাচাররাও একই পথ অনুসরণ করেন, রণাঙ্গনের স্লোগান জয় বাংলাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রদানের আগমুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ এবং রাজনৈতিক নেতা এমনকি ছাত্রলীগ নেতারাও বঙ্গবন্ধুর কাছে অনেক নোট দিয়ে বলেছিলেন, ‘এসব বলতে হবে।’ কাগজের যেন বস্তা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতে যাবেন, ঠিক তার আগে আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বাবাকে ওপরে নিয়ে গিয়ে পাশে বসেন। তখন আমিও বাবার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। মা বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘অনেকে অনেক কথা বলবে। ময়দানে লাখ লাখ মানুষ তোমার মুখের দিকে চেয়ে বসে আছে। তুমি দেশের মানুষের জন্য আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছ। তাই তাদের জন্য কী করতে হবে তোমার চেয়ে কেউ তা বেশি বুঝবে না। তাই তোমার মনে যা আসবে সেটিই বলবে।’ বঙ্গবন্ধু তাই করেছিলেন। কোনো নোট বা লিখিত কাগজ ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর মনে যা ছিল সেটিই ভাষণে বলেছিলেন।
তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে অসহযোগ আন্দোলন হয়েছে, পরে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন থেকেই একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর মতো অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বের আর কোনো নেতাই করতে পারেননি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আলোচনার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন বাঙালি বাবুর্চিরা তার জন্য রান্না করতে পর্যন্ত অস্বীকার করেন। ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে তখন বলা হয়েছিল, ‘একটু অনুমতি দেন, নইলে রাষ্ট্রপতি একটু গরম ভাতও খেতে পারবেন না।’ এমন অসহযোগের ঘটনা বিশ্বে বিরল। একটি অনন্য ইতিহাস রচনা করে গেছেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং ১৯৪৮ থেকে ‘৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা রিপোর্ট নিয়ে প্রকাশিত বইগুলো আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে পড়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই বইগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কত ত্যাগ করেছেন, কত কষ্ট করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর এই একটি মাত্র ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলতে পারছি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আমরা পেয়েছি একটি ভাষাভিত্তিক স্বাধীন দেশ।
সভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ জহির, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. শামসুন্নাহার চাঁপা, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাজি আবুল হাসনাত, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান প্রমুখ। কবিতা আবৃত্তি করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।