জন্মান্ধরা কি স্বপ্ন দেখে? ঘাম কীভাবে রক্তকে শোধন করে? পরিবেশ দূষণ কমাতে মানব শরীরেই বৃক্ষের মতো প্রযুক্তি স্থাপন সম্ভব কি? রোবট মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিধর হলে কী হতে পারে? জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে এ রকম অনেক কৌতূহলী ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রতিযোগিতা পর্বেও তারা দেখাল বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর। তাতে অভিভূত বিশেষজ্ঞ ও গুণী অতিথিরা। সবার কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো নতুনরাই গড়বে বিজ্ঞানভিত্তিক আগামীর সমৃদ্ধ দেশ। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবিক গুণের অধিকারী। এই প্রত্যয়ে গতকাল শনিবার ঢাকা উত্তর ও সিলেট অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হলো বিডিবিও-সমকাল বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান উৎসব। আয়োজনে কারিগরি সহযোগিতা দেয় ল্যাব বাংলা এবং বিশেষ সহযোগিতা করে কথাপ্রকাশ ও ওয়ান ফার্মা। দুই অঞ্চল থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পর্বে অংশগ্রহণের টিকিট পেয়েছে ৩৩৯ শিক্ষার্থী।
ঢাকা অঞ্চল : রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢাকা ও আশপাশের কয়েকটি জেলার সহস্রাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে বসেছিল জীববিজ্ঞান উৎসবের ঢাকা উত্তর অঞ্চলের আসর। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞানে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের পদচারণায় দিনভর মুখর ছিল ক্যাম্পাস। সকালে সাড়ে ৮টায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়। উৎসব উদ্বোধন করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ। উপস্থিত ছিলেন জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ড. শহীদুর রশিদ ভূঁইয়া, জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের ঢাকা উত্তর অঞ্চল কমিটির সভাপতি ড. ছরোয়ার হোসেন প্রমুখ। এর আগে সকাল ৯টা থেকে এক হাজার ১৭ শিক্ষার্থী তিন ক্যাটাগরিতে দেড় ঘণ্টার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ২৩০ জন জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত হয়েছে।
পরীক্ষা শেষে সকাল ১১ থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। মানবদেহ, প্রাণিজগৎ, জিন প্রকৌশল নিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও জানার ব্যাপকতায় বোঝা গেল তাদের চিন্তাশীল ও গভীর সব প্রশ্নে। অনেক প্রশ্নের ভিড়ে কয়েকটি সবার দৃষ্টি কাড়ে। ‘আমরা মানুষ কেন? পরীজীবী বা অন্য গ্রহের কেউ কি মানব মস্তিস্কের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে? গর্ভাবস্থায় শরীরে ভালো গুণাবলির জিন প্রবেশ করানো সম্ভব কি? সিনেমার মতো লাঠির আঘাতে কি স্মৃতিশক্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব? এসব প্রশ্নের সরস উত্তর দিয়েছেন উৎসবে আসা জীববিজ্ঞানী ও জিন প্রকৌশলীরা।
বেলা ৩টায় শুরু হয় সমাপনী অনুষ্ঠান। এ সময় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিক্ষার্থীদের হাতে পদক ও সনদ তুলে দেন অতিথিরা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উর্বর ভূমি। সত্যেন বোস, জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীরা জন্মেছেন এই মাটিতে। তাদের দেখানো পথে তোমরা নতুনরাই বিজ্ঞানভিত্তিক সমৃদ্ধ দেশ গড়বে। তাদের মতো বিশ্বসেরা হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. সেকেন্দার আলী বলেন, প্রকৃত মেধাবীদের খুঁজে বের করতে জীববিজ্ঞান উৎসবের আয়োজন বড় ভূমিকা রাখবে। এর মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে গড়ে উঠবে।
সমকালের ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ বলেন, একা একা ভালো কিছু করা কষ্টকর। সবাইকে নিয়েই ভালো কিছু করা সম্ভব। দেশের প্রতি এই দায়বোধ থেকেই জীববিজ্ঞান উৎসবের মতো উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থাকে সমকাল। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, দেশের রক্তাক্ত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে অংশ নিতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে।
ড. ছরোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন কথাপ্রকাশের কর্ণধার জসিম উদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহেদুর রহমান, ওয়ান ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান, ড. শহীদুর রশিদ ভূঁইয়া প্রমুখ।
সিলেট অঞ্চল :সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসে সিলেট অঞ্চলের জীববিজ্ঞান উৎসব। এ বিভাগের চার জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের বিজ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর ছিল ক্যাম্পাস। উৎসব উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মতিয়ার রহমান হাওলাদার।
বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান উৎসব সিলেট আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডের সভাপতিত্বে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন কাউন্সিলের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবুল কাশেম ও ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ সায়েম উদ্দিন আহম্মদ। স্বাগত বক্তব্য দেন সমকালের সহকারী সম্পাদক ও সুহৃদ সমাবেশের বিভাগীয় সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আবেদ। সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনন্যা তালুকদার জেনি, সমকালের সিলেট ব্যুরোপ্রধান চয়ন চৌধুরী।
প্রশ্নোত্তর পর্বে উত্তর দেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুব ইকবাল, অধ্যাপক মাহবুব আলম, অধ্যাপক আবু জাফর ব্যাপারী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, অধ্যাপক ফারুক মিয়া, সহযোগী অধ্যাপক গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস, মদন মোহন কলেজের অধ্যাপক সুপ্তী চৌধুরী, এমসি কলেজের নেছার আহমদ, ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক সাহেদা আক্তার।
সিলেট বিভাগের চার জেলার ৭২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫২৬ শিক্ষার্থী তিনটি ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতা পর্বে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ১০৯ জন জাতীয় পর্যায়ের টিকিট পেয়েছে।
উপাচার্য মতিয়ার রহমান হাওলাদার বলেন, গত শতাব্দী ছিল পদার্থবিদ্যার। বর্তমান শতাব্দীকে বলা হচ্ছে জীববিজ্ঞানের। সমাজের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান খুঁজে বের করতে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেন তিন।
অধ্যাপক আবুল কাশেম বলেন, জীববিজ্ঞান উৎসবের মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের সাহস সঞ্চয় হচ্ছে। টমাস আলভা এডিসনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ভুল থেকে শিক্ষা নিলে জীবনে জয়ী হওয়া যায়।
অধ্যাপক সৈয়দ সায়েম উদ্দিন আহম্মদ বলেন, বিজ্ঞানকে জানার চেষ্টা করতে হবে। ভাসা ভাসা কোনো কিছু বিজ্ঞান নয়। কোনো কিছু প্রমাণ হলেই তা বিজ্ঞান।
সমকালের সহকারী সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আবেদ বলেন, তরুণ সমাজের সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ- মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস। এই জায়গা থেকে নতুন প্রজন্মকে বের হয়ে আসতে হবে।
জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ীদের নিয়ে বায়ো ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হবে। সেখান থেকে সেরাদের সেরা চার শিক্ষার্থী অংশ নেবে হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠেয় ৩০তম আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে।