ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা পৌরসভার ড্রেন নির্মাণ, সোলার লাইট ও নলকূপ স্থাপনের নামে অর্থ বরাদ্দ নিচ্ছেন জলবায়ু তহবিল থেকে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অভিযোজন প্রকল্প ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের উন্নয়নে এই অর্থ ব্যয় করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অপাত্রে জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দ করায় উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদী ও ভুক্তভোগীরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও মহাখালীতে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড কার্যালয়ে দলীয় এমপি, মেয়র ও সদ্য নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ভিড় বেড়েছে। সবাই আসছেন তদবির করে প্রকল্প বাগিয়ে নিতে। কারণ আগামী মাসেই জলবায়ু তহবিল ট্রাস্ট বোর্ডের মিটিং রয়েছে। অবশ্য নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন পৌরসভার ড্রেন নির্মাণের নামে ট্রাস্টের তহবিল থেকে শতাধিক প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, পৌরসভার ড্রেন নির্মাণ ও সোলার লাইট স্থাপন প্রকল্পের নামে জলবায়ু তহবিলের অর্থ হরিলুট হচ্ছে।
পৌরসভার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ বিদেশি অনেক সংস্থাই কাজ করে থাকে। এর পরও পৌরসভার বিশেষ করে ড্রেন নির্মাণের নামে অর্থ বরাদ্দ করায় অনেকে রসিকতা করে বলছেন, জলবায়ু তহবিলের টাকা যাচ্ছে ড্রেনে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতি হওয়া দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটি) অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতি হওয়া এলাকার পৌরসভাগুলোয় নামমাত্র বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সিংহভাগই যাচ্ছে প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের এলাকায়।
জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে ২১৭টি পৌরসভা অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৪টি পৌরসভা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে পড়েছে। বরাদ্দ পাওয়া অন্য ১৯৩টি পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তালিকায় নেই। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পেয়েছে ১৪৩টি প্রকল্প। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় পেয়েছে ৬৬টি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় পেয়েছে সাতটি প্রকল্প। এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয় ১৮টি এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয় ৫৩টি প্রকল্প পেয়েছে। সব মিলিয়ে ৩৩৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। জলবায়ু তহবিলের অর্থে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৬৮৭টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পে সর্বমোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তিন হাজার একশ’ পঞ্চাশ কোটি পাঁচ লাখ টাকা।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পৌরসভা, নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভা এবং টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী পৌরসভা ড্রেন নির্মাণের জন্য দুই কোটি থেকে তিন কোটি টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছে। চাঁদপুর পৌরসভা পেয়েছে সাড়ে ১১ কোটি টাকা। বাউফল পৌরসভা পেয়েছে সাড়ে সাত কোটি টাকা। গাজীপুরের কালিয়াকৈর, চরফ্যাসন, ময়মনসিংহ, লালমোহন ও ভোলা পৌরসভার প্রতিটি পেয়েছে পাঁচ কোটি টাকা করে। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার প্রতিটি পেয়েছে তিন কোটি টাকা করে। বেনাপোল ও মাগুরা পৌরসভা সোয়া তিন কোটি টাকা করে এবং ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ পৌরসভা পেয়েছে দুই কোটি টাকা।
সম্প্রতি সচিবালয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পিএসের কক্ষে কথা হয় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ পৌরসভার যুবলীগ নেতা আবদুস সাত্তারের সঙ্গে। পৌরসভার জলাবদ্ধতা নিরসনের একটি প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি। পাশে বসা আবদুস সালাম এসেছিলেন কুমিল্লার বরুড়া পৌরসভার সড়কবাতি প্রকল্পের তদবির করতে। তাদের মতো আরও অনেক নেতাই স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রীদের সুপারিশ নিয়ে এখনও প্রকল্প জমা দিচ্ছেন।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার বলেন, গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রকল্প ছাড় করেছি। সোলার লাইট স্থাপনের জন্য দুই কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। শিগগির প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
সদ্য বিলুপ্ত ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র এবং নবগঠিত ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. ইকরামুর হক টিটু বলেন, দুটি প্রকল্প জমা দিয়ে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ড্রেন নির্মাণের জন্য প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভা। প্রকল্পের কাজ শেষ। তবে এখনও কয়েক কিস্তির টাকা বাকি রয়েছে।
টাঙ্গাইল পৌরসভার প্যানেল মেয়র তানভীর হাসান ফেরদৌস জানান, টাঙ্গাইল পৌরসভা দুই কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। তবে এখনও অর্থ ছাড় হয়নি। প্রকল্পের কাজও শুরু হয়নি।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান বলেন, জলবায়ু তহবিলের দুই কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়ে একটি ড্রেন ও একটি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু তহবিল বরাদ্দের নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। জলবায়ু প্রশমন খাতে নয়, অভিযোজন খাতের প্রকল্পকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তা হলে রাজনৈতিক প্রভাব কমবে এবং জলবায়ু তহবিলের অর্থ অপাত্রে যাওয়া বন্ধ হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বরাদ্দ কম। কারণ প্রকল্প গ্রহণে জলবায়ু তহবিলের নীতিমালা মানা হচ্ছে না। রাজনৈতিক প্রভাবে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকার নৈতিকভাবে এটা করতে পারে না। পৌরসভার ড্রেন নির্মাণের নামে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে লুটপাট কারও কাম্য নয়।
এ বিষয়ে নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশের সমন্বয়কারী মিজানুর রহমান বিজয় বলেন, ঝিনাইদহ ও কেশবপুরসহ অনেক এলাকায় পৌরসভার রাস্তায় সোলার লাইট স্থাপনের জন্য জলবায়ু তহবিল থেকে দুই কোটি টাকা করে বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। রাস্তা তৈরি হয়নি, এমন এলাকায়ও লাইট জ্বালানো হচ্ছে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের এলাকায় এমন ঘটনা বেশি ঘটছে। নেতারা জলবায়ু তহবিলের টাকা লুটপাট করতে পৌরসভাকে বেছে নিয়েছে। কারণ পৌরসভার বরাদ্দ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে সরাসরি চলে যায়। পৌরসভা ছাড়া এ বরাদ্দের খবর আর কেউই জানে না এবং তা মনিটর করারও কেউ থাকে না। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ হলে মন্ত্রণালয় থেকে বিভাগীয় অফিস হয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে কাজ হয়। এতে স্থানীয় প্রশাসনের প্রকল্প মনিটর করার সুযোগ থাকে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. সাইফুল ইসলাম জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা উপকূলীয় অঞ্চল। অথচ সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশাল, উত্তরবঙ্গ ও হাওরাঞ্চলে বরাদ্দ কম। জলবায়ু তহবিলের এমন অপব্যবহার অব্যাহত থাকলে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ সহায়তা পেতে সমস্যা হবে।
অবশ্য বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীপক কান্তি পাল বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়ই বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকতে পারে। স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে পৌরসভার প্রকল্প বেশি আসছে। তাই কারিগরি কমিটি ও জলবায়ু ট্রাস্টি বোর্ড এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ অনুমোদন করছে। আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নামে বেশি প্রকল্প বরাদ্দ হতো। এখন পৌরসভায় হচ্ছে। পৌরসভার নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন তদারকির দায়িত্ব পালন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল্লাহ আল মোহসিন চৌধুরী বলেন, মন্ত্রণালয়ে ১০০টি প্রকল্প প্রস্তাব জমা হলে দেখা যায় ৮০টির বেশি এসেছে পৌরসভা থেকে। সঙ্গত কারণেই পৌরসভার প্রকল্পগুলো অর্থ বরাদ্দ পাচ্ছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন ভিন্ন নতুন পরিকল্পনার প্রকল্প এলে বিবেচনা করে বরাদ্দ দেওয়া হবে। বরাদ্দ পাওয়া প্রকল্পগুলো নিয়মিত মনিটর করা হচ্ছে। ফান্ডের অর্থ বরাদ্দ শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন. নতুন বরাদ্দ পাওয়ার পর আবারও প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সরকারি সফরে বিদেশে থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, তারা মার্চের শেষে দেশে ফিরবেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় দুটি তহবিল গঠন করে। এর একটি হলো বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (বিসিসিটি) এবং অন্যটি বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড (বিসিসিআরএফ)। সরকার নিজস্ব অর্থ দিয়ে প্রথমে এ তহবিল গঠন করলেও পরে এতে অনেক দেশ অর্থায়ন করে। তবে সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও উন্নয়ন সহযোগীদের মতৈক্য না হওয়ায় যুক্তরাজ্যের সরকারি সংস্থা ডিএফআইডি বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড থেকে এ দেশের জন্য বরাদ্দ এক কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড ফেরত নিয়ে গেছে। শুধু যুক্তরাজ্য নয়, পাঁচ কোটি ডলার বা ৪০০ কোটি টাকা ফেরত নিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ান এইড, ইউএসএআইডি, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। প্রকল্প মানসম্মত না হওয়ায় পাঁচ কোটি ডলার ফেরত নিয়ে গেছে বিশ্বব্যাংক।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থায়ন করতে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার করে ছাড় করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে উন্নত বিশ্বের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু ঝুঁকির শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ জলবায়ু তহবিলের অর্থের বড় দাবিদার হলেও মানসম্পন্ন ও নতুন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে গৎবাঁধা প্রকল্প ও প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এরই মধ্যে জলবায়ু তহবিল থেকে বিশ্বের ১১৮টি দেশ অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে। এ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাম।