বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে সারাদেশের সব মহকুমায় ইপিআরের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে একটি তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সেই তারবার্তাটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনেক গভীর। সারাদেশে মুক্তির যুদ্ধকে ছড়িয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা। বার্তাটি পেয়েছিলেন অনেকেই, কিন্তু ওই তারবার্তার একমাত্র কপিটি এখন রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসংগ্রামী কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর সহধর্মিণী রোকেয়া চৌধুরীর সংগ্রহে, যা তিনি তুলে দিতে চান বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে।
১৯৯১ সালে মারা যান মানিক চৌধুরী। সেই থেকে রোকেয়া চৌধুরী ছোট্ট একটি কৌটায় ভাঁজ করে রেখেছিলেন স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া অমূল্য এই সম্পদ। বয়সের ভারে শরীর নুয়ে পড়েছে তার। ৭৬ বছর বয়সী এই নারী এখন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। চোখেও তেমন দেখতে পান না। তাই শেষ বয়সে বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে স্বাধীনতা ঘোষণার এই দলিলটি তুলে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই পরিবারের কাউকে না জানিয়ে পাঁচ দিন ধরে চার পাতার একটি চিঠি লিখেছেন।
মানুষের কাছে মানিক চৌধুরী নামে পরিচিত এ কে লতিফুর রহমান চৌধুরী ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো তারবার্তাটি যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস মানিক চৌধুরী নিজের বুক পকেটে নিয়ে ঘুরেছেন। যুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালে সিলেটের ‘যুগভেরী’ পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিকে দিকে যে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন, সেই বার্তার একটি কপি আমিও পেয়েছিলাম। রাত প্রায় ৪টার সময় আমার ঘরে শব্দ হলো, পিয়ন এসে আমাকে একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল। যে টেলিগ্রাম দিয়ে গেল, সে টেলিগ্রামটি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এসেছে বাংলার স্বাধীনতার বার্তা নিয়ে। তিনি ঘোষণা করছেন, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম আরম্ভ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন এবং শত্রুসেনাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। এটাই আমাদের প্রথম সংবাদ।’
রোকেয়া চৌধুরী জানান, মারা যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর তারাবার্তাটি তার হাতে দিয়ে যত্নে রাখতে বলেছিলেন মানিক চৌধুরী। সেই থেকে আজ অবধি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার এই দলিলটি আগলে রেখেছেন রোকেয়া। মানিক চৌধুরী বলেছিলেন, কোনো অবস্থায় যেন এটি নষ্ট না হয়। একটা সময় এই পত্রটিই মূল্যবান হয়ে উঠবে। রোকেয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমার তো বয়স হয়ে গেছে। বলা যায় না, কখন কী হয়। বঙ্গবন্ধুর মেয়ের হাতে এই ঘোষণাপত্রটা দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব সম্পন্ন হবে। আমি মরেও শান্তি পাব।’
রোকেয়া চৌধুরীর কাছে সংরক্ষিত তারবার্তাটিই এখন পর্যন্ত পাওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ওই বার্তার একমাত্র কপি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক জানান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মানিক চৌধুরীর পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তারবার্তাটির একটি ফটোকপি রয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণা সারাদেশেই পাঠানো হয়েছিল। এই তারবার্তাটি যারা পেয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, ওই বার্তায় স্পষ্টতই ঢাকার পরিস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে এবং সবাইকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে মানিক চৌধুরীর পরিবারের কাছে সংরক্ষিত ওই তারবার্তাটি ছাড়া আর কোনো কপি কোথাও পাইনি আমরা। তাই ওই কপিটিরই একটি ফটোকপি আমরা জাদুঘরে সংরক্ষণ করেছি।’
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘২০১২ সালে মানিক চৌধুরীকে নিয়ে আমি লিখেছি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তাটি মানিক চৌধুরীকেও পাঠিয়েছিলেন। তার ফটোকপিও জাদুঘরে দেওয়া হয়েছে।’
তারবার্তাটিতে ইংরেজিতে লেখা আছে- ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিলখানায় ইপিআর ও রাজারবাগে পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেছে। নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে। ইপিআর ও পুলিশ ঢাকার রাজপথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। জনগণ প্রাণপণে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির জনগণকে যে কোনো মূল্যে শত্রুবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আহ্বান জানানো যাচ্ছে। আল্লাহ আপনার মঙ্গলে সহায়তা করুন। জয় বাংলা। মুজিবুর রহমান।’
শেখ ফজলে এলাহীর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ’ বইয়ে এই তারবার্তাটির কথা জানা যায়- ‘মানিক চৌধুরী শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রেরিত টেলিগ্রাম নিয়ে উপস্থিত হন মহকুমা হাকিম অফিসের বটতলায়। সেখানে উপস্থিত হয়েছিল হাজার খানেক মানুষ। মানিক চৌধুরী একটি ট্রাকের ওপর উঠে ইংরেজিতে লেখা টেলিগ্রাম সবাইকে দেখিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণার বিবরণ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রেরিত এ তারবার্তা জনগণকে উদ্বেলিত করে তোলে। অনির্ধারিত ওই জনসভায় মানিক চৌধুরী এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে সবাইকে আহ্বান জানান প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। মানিক চৌধুরীর আহ্বানে সমবেত জনতা সমর্থন জানায় বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মাধ্যমে। মানিক চৌধুরীর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে হবিগঞ্জ মহকুমায় সূচনা হয় প্রতিরোধ সংগ্রামের।’
মানিক চৌধুরীর মেয়ে সাবেক সাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমার আব্বা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে হবিগঞ্জের আপামর মানুষ তাকে কমান্ড্যান্ট উপাধিটা দিয়েছিল। আব্বাকে আমি বেশি দিন পাইনি। ছোটবেলায় তাকে হারিয়েছি। এত অল্প সময়ে আব্বাকে যতটুকু দেখেছি, তা আমার স্মৃতিতে জীবন্ত ও স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু আর দেশের প্রতি বাবার যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ- তা মায়ের মধ্যেও পেয়েছি।’ তিনি জানান, ‘দুটি চশমা এক করে, কাউকে কিছু না বলেই আমার মা প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠিটি লিখেছেন। ওই চিঠিতে আমি বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসা দেখেছি। বাবার দেওয়া অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্যই মা মূল কপিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করবেন বলে মনস্থ করেছেন।’
মানিক চৌধুরী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কখনও রাজধানীকেন্দ্রিক রাজনীতি করেননি। সারাজীবন থেকেছেন প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে। দু’বার (১৯৭০ ও ১৯৭৩) জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। হবিগঞ্জ শহরের বাড়িটি (মানিক চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি) ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর অনেক দিন লেগেছিল নতুন বাড়ি করতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর মানিক চৌধুরীকেও গ্রেফতার করা হয়। সাড়ে তিন বছর পর মুক্ত হন তিনি। তারপর পুড়ে যাওয়া বাড়িতে টিনের ছাপড়া ঘর করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই ছাপড়াতেই বসবাস করেছেন। কেয়া চৌধুরী পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ওই জমির ওপর ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ এবং ‘ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর সম্মানে এই জাদুঘর নির্মাণে এক কোটি ৪১ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছেন। ২০১৮ সালের ২১ মার্চ এই জাদুঘর ও পাঠাগারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মানিক চৌধুরীর স্ত্রী রোকেয়া চৌধুরী। কেয়া চৌধুরী জানান, জাদুঘরের গ্যালারিতে মানিক চৌধুরীসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্মারক প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে। এখানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটিরও একটি অনুলিপি থাকবে। তবে মূল কপিটি বাবার ইচ্ছানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেবেন তার মা।