প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালির মুক্তি, স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলনে নেতৃত্বদাতা আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য বারবার চেষ্টা হয়েছে। এই দলকে শেষ করে দেওয়ার জন্য আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়া চেষ্টা করেছেন। তবে কেউই আওয়ামী লীগকে শেষ করতে পারেননি। কারণ আওয়ামী লীগের শিকড় বাংলার মাটির গভীরে, এ দেশের জনগণের হৃদয়ে প্রোথিত।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কেউই আর এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলতে পারবে না। কেউ বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ এ দেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো।’
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সংগঠনকে শক্তিশালী ও উন্নত করতে হবে। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যেটি বাঙালি জাতির সেবা করে।
পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্ষমতাসীন সামরিক স্বৈরশাসকদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গণতন্ত্র নাই গণতন্ত্র নাই’ বলে যে যতই চিৎকার করুক, সামরিক স্বৈরশাসক ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা দেশের কোনো উন্নয়ন ও কল্যাণ করতে পারে না। গণতন্ত্র দিতে পারে না। বরং দেশের মানুষকে তারা ভিক্ষুকে পরিণত করে ফেলেছিল। অন্যদিকে, যে দল মাটির শিকড় থেকে গড়ে ওঠে শুধু তারাই দেশ ও মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণ করতে পারে, পেরেছে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক এবং মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের গৌরবোজ্জ্বল অবদান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এটি জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন। আওয়ামী লীগ মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে।
তিনি বলেন, এই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেওয়ার জন্য বারবার চেষ্টা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। এতে প্রমাণ হয়, যারা প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে, তাদের শেষ করা যায় না। যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে উচ্ছিষ্ট ছিটিয়ে দল গড়ে তোলে, তাদের গোড়ায় কিছু থাকে না। সেজন্য ক্ষমতা ছাড়া তাদের অস্তিত্বই থাকে না।
বক্তব্যের শুরুতে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতির দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাঙালিকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। তার নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে, অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্র বিপ্লবে রূপ দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণনীতির প্রসঙ্গ তুলে ধরতে প্রধানমন্ত্রী ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের ডন পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন। ওই আমলে সামরিক বাহিনী, প্রশাসনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালিকে বঞ্চিত করার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান মরুভূমির দেশ। আমাদের অর্থ দিয়ে মরুভূমিতে ফুল ফুটিয়েছিল পাকিস্তানিরা। আমাদের দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করতে চেয়েছিল তারা। আমরা পাট-চা-তামাক বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতাম। সব নিয়ে যেত পাকিস্তানিরা। পাকিস্তান রাজধানী পরিবর্তন করেছে তিনবার। একটা ছিল করাচি, এরপর ইসলামাবাদ এরপর পিণ্ডি। যতবার রাজধানী পরিবর্তন হয়েছে তার অর্থ আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে। টাকা দিতে হতো আমাদের, আর ভোগ করত তারা।’
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের এই বৈষম্যনীতির অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। সে জন্য ধাপে ধাপে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাকিস্তানিদের গণহত্যার পর পাকিস্তানের শেষ সৈন্য বিতাড়ন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে– ওয়্যারলেসের মাধ্যমে এ ঘোষণা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দিয়েছিলেন। ওয়্যারলেসের এই বার্তার কথা পাকিস্তান জানার পর তাকে ৩২ নম্বর থেকে ধরে নিয়ে গেল। তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হলো, তাকে ফাঁসি দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমরা ভারতের মিত্রবাহিনীর সহযোগিতা পেলাম। এ দেশের মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের ৯৬ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। আন্তর্জাতিক চাপে ইয়াহিয়ার পতন হলো, ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হলেন। মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন। মাত্র নয় মাসের মধ্যে তিনি আমাদের সংবিধান দিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে গেল। পৃথিবীর যেসব দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে মিত্রবাহিনী সহযোগিতা করেছে, কোনো দেশ থেকেই কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মিত্রবাহিনীর ফেরত যাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম, যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে মিত্রবাহিনী ফেরত গিয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনচেতা নেতৃত্বের কারণে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না। স্বাধীনতাবিরোধী, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা এক হয়ে চক্রান্ত শুরু করে। তাদের সঙ্গে ছিল আন্তর্জাতিক শক্তি, যারা পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছিল, অর্থাৎ যারা বাঙালির বিজয় একেবারে মেনে নিতে পারেনি- তারাও কিন্তু ষড়যন্ত্র শুরু করে। একে একে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়, ব্যাংক লুট করা হয়, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া হয়। ষড়যন্ত্রকারীরা এ জন্য হাত করে আমাদের কিছু লোককেও।’
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশগঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেই চক্রান্ত মোকাবেলা করেই বঙ্গবন্ধু দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন, অনেকে যেটাকে বাকশাল বলে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এক প্ল্যাটফরমে নিয়ে এসে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই এটা করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর এই জাতীয় ঐক্যের ফলে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধুর এই পদ্ধতিতে মানুষের জীবনে শান্তি নেমে এসেছিল, তারা সুখের মুখও দেখতে শুরু করেছিল। ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী শক্তি আর তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা নতুন করে চক্রান্ত শুরু করে। সেই ষড়যন্ত্রের কারণেই জাতির জীবনে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, পঁচাত্তরের পর হত্যা-ক্যু আর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি শুরু হয়। ১৯টি ক্যু হয়েছিল। এরপর প্রতি রাতে কারফিউ, কারও স্বাধীনভাবে চলার অধিকারও ছিল না। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়, দুর্নীতি-লুটপাট ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আর অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য তোষামোদি, খোশামোদি ও চাটুকারের দল সৃষ্টি করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে পরাজিত শক্তি বাঙালি জাতিকে নিঃশেষ করে ফেলার চেষ্টা চালায়। ইতিহাস বিকৃত করে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার নেতৃত্বও মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পারেনি। কারণ সত্যকে কেউ চেপে রাখতে পারে না। সত্য একদিন না একদিন উদ্ভাসিত হয়– সেটাই আজ প্রমাণ হয়েছে। যদিও এর জন্য সময় লেগেছে, একটা প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জেনেছে।
গত ১০ বছরে তার সরকারের উন্নয়নের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য কাজ করেছে বলেই দেশ এখন অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত ১০ বছরে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। আজ বাংলাদেশকে কেউ আর ভিক্ষুকের জাতি বলে অবহেলার চোখে দেখে না। বাংলাদেশ আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বের বুকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।
সভায় আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, রমেশ চন্দ্র সেন, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ, দক্ষিণের সভাপতি আবুল হাসনাত, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য আমিরুল আলম মিলন, এস এম কামাল হোসেন প্রমুখ। কবিতা আবৃত্তি করেন অধ্যাপক মেরিনা জাহান কবিতা।
সভা পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।