গ্রামের নাম মনিপুর। সুরমা নদীর তীর ধরে বেড়ে ওঠা গ্রামটিতে খুব একটা মানুষের বসবাস নেই। তবে ছোট ছোট দুটি টিলায় চার-পাঁচ পরিবারের বসবাস রয়েছে।
টিলায় উৎপাদিত ফসল আর নদীতে মাছ ধরেই চলে তাদের জীবিকা নির্বাহ। টিলায় অবস্থিত ঘরগুলো আকারে খুবই ছোট তার উপর ঘন গাছপালা তো আছেই। ফলে নদীর ওপার থেকে গ্রামটিতে মানুষের বসবাস তেমন একটা বুঝা যায় না।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই-তিন মাস পরের ঘটনা। যখন নদীর অন্য পারের গ্রামগুলোতে কোনো না কোনোভাবে পাকবাহিনী আক্রমণ করছিল। তখনো মনিপুর গ্রামে কোনরকম আক্রমণ হয়নি।
এর বেশ কিছু কারণ আছে, যুদ্ধ শুরুর আগ থেকেই এখানকার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর বেশিরভাগ লোকজনই জানতো যে, টিলাঘেরা এই মনিপুরে তেমন কারো বাস নেই, আর যে কয়জন থাকে ওরা নদীতে মাছ ধরা আর চাষাবাদ করেই চলে।
সেই থেকে মুক্তিসেনারা গ্রামটিকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। আস্তে আস্তে ছোটো-খাটো অপারেশন চলতো। তাও লোকচক্ষুর আড়ালেই।
জালাল সর্দার। বয়স খুব একটা না হলেও মনিপুর গ্রামে যে কয়জন বসবাস করে তাদের চাইতে তিনিই বড়। তার কথা সবাই মান্য করে। সুখে দুঃখে পাশে পায়। তার কারণেই গ্রামে মুক্তিসেনাদের আশ্রয়ের সুযোগ হয়।
যুদ্ধ চলাকালীন জালাল সর্দার গ্রামের সবাইকে একত্রিত করে দেশের উদ্ভুত পরিস্থিতির বিস্তর বর্ণনা করলেন। পাশাপাশি সবাইকে সাবধানে চলাফেরার নানা বিষয়ে কৌশল বাতলে দিলেন।
এর কিছুদিন পর জালাল সর্দারের মাথায় ভিন্ন চিন্তা এসে ভিড় করে। মনিপুর গ্রামের যে কয়জনই আছে সবাই মোটামুটি নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরে। তাছাড়া এপার ওপার হওয়ার কাজ তো আছেই। এখন কথা হচ্ছে, এসব নৌকার ব্যাপারে যদি পাকবাহিনী খবর পায় তাহলে নিশ্চয়ই গ্রামে আসতে চাইবে। সবকিছু ফাঁস হয়ে গেলে বিরাট ক্ষতির সম্ভাবনা তো আছেই।
জালাল সর্দার ঠিক করলেন এখন থেকে নৌকাগুলো আর ঘাটে বাঁধা যাবে না। নোঙর করে পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পাশাপাশি দিনের বেলা পারাপার কিংবা মাছ ধরা এসবও করা যাবে না। ঠিক সেরকমই চলতে থাকলো।
আস্তে আস্তে গ্রামটিতে মুক্তিসেনাদের যাতায়াত বাড়তে থাকলো। যুদ্ধে ব্যবহৃত নানাবিধ জিনিসপত্র এখানে এনে রাখা হতো। মুক্তিসেনাদের বাইরেও অন্যান্য গ্রাম থেকে পালিয়ে নানা লোক আশ্রয় নিতে আসে। তাও শুধু রাতের বেলা পারাপার করতে হয়।
একবার সন্ধ্যার পর পানিতে ডুবিয়ে রাখা নৌকা তোলা অবস্থায় দেখে ফেলে ওপারের মানিক বেপারী। তার মনে সন্দেহ জাগে। মনে মনে ফন্দি আঁটতে থাকে পাকবাহিনীর সহযোগী মানিক বেপারী। স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজ দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেও দ্বিধাবোধ করেনি এসব মানিক বেপারীরা। তাদের সহযোগিতার ফলে পাকবাহিনী বাংলার নিরীহ মানুষদের উপর যেভাবে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছে, তা শুনলে পরে গা শিউরে ওঠে।
মানিক বেপারী পরদিন তার অন্য এক সহযোগীকে পাঠায় মনিপুর গ্রামে। সব দেখে এসে যাতে খবর দিতে পারে। গ্রামে হঠাৎ একদম অপরিচিত লোক দেখতে পেয়ে সন্দেহ হয় জালাল সর্দারের। তার বুঝতে আর বাকি রইলো না যে, শকুনের কালো চোখ এখানে এসে পড়েছে।
বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন জালাল সর্দার। গ্রামে অবস্থানরত সবাইকে একত্রিত করে এ নিয়ে কথা বললেন। পরামর্শ অনুযায়ী কৌশল অবলম্বন করতে মুক্তিসেনারা সেদিন থেকেই প্রতি রাতে গ্রামের পূর্ব দিকটায় বলতে নদীর পার দিয়ে চলাচলের রাস্তার এক পাশে অবস্থান নিতে থাকেন। আর গ্রামের অন্যদের টিলার পেছনের দিকটায় থাকার ব্যবস্থা করা হলো।
মানিক বেপারীর পাঠানো সোর্স গ্রাম ঘুরে এসে বিস্তর তথ্য দেয়। সব শুনে মানিক বেপারীর চোখে মুখে হাসির ঝিলিক উপচে পড়ার মতো। পাকবাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলে মানিক বেপারী। সেরা একটা সুযোগ মনে করে সেখানে আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। রাতের শেষ ভাগে আক্রমণ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। সদলবলে অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত হয়ে মধ্যরাত থেকেই প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করে।
রাত তিনটা ছুঁইছুঁই। এতো গভীর রাতে মানুষ তো দূরের কথা বেশিরভাগ পশুপাখিও জেগে থাকে বলে মনে হয় না। হঠাৎ করেই মুহুমুর্হু গুলির আওয়াজে চারপাশ প্রকম্পিত হতে থাকে। আগে থেকেই কৌশলী অবস্থানে থাকা মুক্তিসেনাদের বুঝতে আর বাকি নেই। নিজেদের অবস্থান জানান না দিয়েই চুপচাপ থাকে।
পাকসেনারা আচ্ছামতো গুলি ছুড়তে থাকে। একটা পর্যায় এসে তাদের গুলাগুলি শেষ হয়। তারা ভেবে নেয় সফল হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের এ ভাবনা যে নিছক কাল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। মনের খুশিতে যখন নদীর তীর ধরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ঠিক তখনি বাংলার বীর সেনাদের আক্রমণ।
চতুর্মুখী আক্রমণে কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই পাকসেনাদের গতিরোধ করতে সক্ষম হয়। পূর্ব কৌশলী অবস্থার কারণেই সেদিন মুক্তিসেনাদের হাতেই পাকসেনা আর তাদের সহযোগী দোসর কতিপয় মানিক বেপারীদের প্রাণ হারাতে হয়। কম করে হলেও ২৫ থেকে ৩০ জনের উপরে মারা যায়।
রাতের গভীরতা কমে আকাশটা পরিষ্কার হতে শুরু করছে। মুক্তিসেনাদের সবাই একে একে জড়ো হলেন। সবার চোখে মুখে স্বস্তির ছাপ। জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গনে ব্যস্ত সবাই। ততক্ষণে লাল টুকটুকে সূর্যটা পূর্ব দিকে উদিত হতে লাগলো। চারদিক থেকে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তে থাকলো।
ওপারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃত পাকসেনাদের রক্ত বহমান নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা উপভোগ করতে থাকেন সবাই। চারপাশে স্বস্তির নিঃশ্বাস বিরাজ করছিলো। সেদিনের কৌশলী অবস্থানের কারণে বেঁচে যান মুক্তিসেনা এবং মনিপুর গ্রামের সাধারণ মানুষ। আর এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে বাংলার স্বাধীনতার যাত্রা।