অন্যায়- অনাচারের বিরুদ্ধে শুভবোধ জাগ্রত হওয়ার বাসনাকে ধারণ করে নতুন বছরকে বরণ করে নিল ছায়ানট। ছায়নটের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন আরেকটি বাংলা বছরকে স্বাগত জানাল দেশের মানুষ। দিনটিকে স্বাগত জানাতে, উদ্যাপন করতে সমগ্র বাঙালি জাতি আজ এক কাতারে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বাঙালির একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দিন এটি।
প্রতিবছরের মতো এবারও বাংলা বছরের প্রথমদিন রোববার সকাল সোয়া ছয়টার দিকে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভোর থেকেই রমনার বটমূলে নানা শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষের সমাগম ঘটে। রঙিন পোশাক আর চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তারা।
আয়োজন শুরু হয় অসিত কুমার দের রাগালাপ দিয়ে। ছায়ানটের বড় ও ছোটদের দল সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনায় ১৩টি গান। এ ছাড়া একক সঙ্গীত পরিবেশন করে ১৩ জন শিল্পী। তাদের মধ্যে রয়েছেন খায়রুল আনাম শাকিল, লাইসা আহমদ লিসা, চন্দনা মজুমদার, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, সুমন মজুমদার, তানিয়া মান্নান, সঞ্জয় কবিরাজ প্রমুখ।
আরও ছিল আবৃত্তি। গানগুলো নির্বাচন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুল প্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, লালন শাহ্, মুকুন্দ দাস, অজয় ভট্টাচার্য, শাহ আবদুল করিম, কুটি মনসুর ও সলিল চৌধুরীর লেখা থেকে।
জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণার আগে ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন শুভবোধ জাগরণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আজ ১৪২৬ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ। বৎসরকাল পেরিয়ে আমরা আবার নতুন দিনের মুখোমুখি। কেমন সময় পেরিয়ে এলাম?
সন্জীদা খাতুন বলেন, চোখ মেললে কিংবা কান পাতলে নিত্যই শিশু, নারী, বল-ভরসাহীন মানুষ তথা সমগ্র মানবতার উপরে নির্মম আচরণের সংবাদ, নিয়ত মার খাচ্ছে সমাজের ধারণা। কোথায় যাচ্ছি? নিষ্কলুষ শিশুসন্তান কোনো সমাজবাসীর অত্যাচারের শিকার হয় কী করে? সমাজ কি পিতামাতা, ভাইবোন, সন্তানসন্ততির গৃহ আর প্রতিবেশী নিয়ে গঠিত শান্তি-নিবাস নয়? নববর্ষ যদি ভ্রাতৃত্ববোধ-মানবতাবোধের উন্মেষ না ঘটাতে পারে, তবে নতুন দিন কি বার্তা নিয়ে আসে?
তিনি বলেন, অন্তরে ইচ্ছা জাগুক, ‘ওরা অপরাধ করে’ কেবল এই কথা না বলে, প্রত্যেকে নিজেকে বিশুদ্ধ করবার চেষ্টা করি। আর, আমরা যেন নীতিবিহীন অন্যায়-অত্যাচারের নীরব দর্শকমাত্র হয়ে না থাকি। প্রতিবাদে, প্রতিকার সন্ধানে হতে পারি অবিচল। নববর্ষ এমন বার্তাই সঞ্চার করুক আমাদের অন্তরে।
বর্ষবরণ ১৪২৬ সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতার। বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠান দেখা যায় ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে।
এবারও কঠিন নিরাপত্তা ছিল ছায়ানটের প্রভাতি আয়োজনকে ঘিরে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া শনিবার বলেন, ছায়ানটের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে থাকবে অন্তঃবেষ্টনী ও বহিঃবেষ্টনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট পথ দিয়ে রমনা উদ্যান ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করতে ও বের হতে হবে। এদিন প্রত্যেক নাগরিককে ফুল ও বাতাসা দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবে ডিএমপি।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে যাত্রা শুরু হয় ছায়ানটের। ছায়ানট বাংলা নববর্ষকে আবাহন জানানোর প্রয়াস নেয় ১৯৬৭ সালে। পাঁচ দশক ধরে বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রভাত অর্থাৎ, পহেলা বৈশাখের ভোরে রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান করে আসছে এ সংগঠন। ২০০১ সালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের এ অনুষ্ঠানে জঙ্গিরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।