এসএস স্টিলের কাছে ৩৫ কোটি ৩২ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে ২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা করে জনতা ব্যাংক। মামলা দায়েরের দেড় যুগ এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। আজ অবধি সেই টাকার কোনো সুরাহা হয়নি। ২০১৫ সালে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ পেয়েছেন গ্রাহক। এই স্থগিতাদেশের কারণে এসএস স্টিলকে খেলাপি দেখাতে পারছে না ব্যাংক। আবার টাকা আদায়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগও নিতে পারছে না।
একই ব্যাংকের আরেক খেলাপি গ্রাহক নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া জুট মিল। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের পাওনা ৯৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আদায়ে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৩-এ মামলা হয়। পরে গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে এক আদেশের মাধ্যমে অর্থঋণ আদালতের মামলাটি স্থগিত করে দেন উচ্চ আদালত। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত থেকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হস্তান্তর করা হয়। তখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন নারায়ণগঞ্জের মুড়াপাড়া এলাকার মৃত গুলবক্স ভূঁইয়ার ছেলে রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া। তবে হস্তান্তর চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে মিলের মেশিনারিজ বিক্রি এবং মিলের উৎপাদন বন্ধ রাখায় ২০১৭ সালে পুনরায় অধিগ্রহণ করে সরকার।
শুধু এসএস স্টিল বা গাউছিয়া জুট মিল নয়। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ব্যাংকগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতের মামলায় এক লাখ ১০ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা আটকে আছে। এর বাইরে উচ্চ আদালতে রিটের কারণে খেলাপি দেখানো যাচ্ছে না এরকম ঋণ রয়েছে ৫২ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এই অর্থের বেশিরভাগই রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এসব ঋণ থেকে কোনো আয় না এলেও ব্যাংকগুলোকে মামলা পরিচালনা ও হিসাব রক্ষণে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। আদালতের স্থগিতাদেশের ফলে কেন্দ্রীয় ঋণ তথ্য ব্যুরো বা সিআইবি রিপোর্টে নিয়মিত ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এতে করে এক ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করেও আরেক ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এসব অসাধু গ্রাহক।
এ পরিস্থিতির উন্নয়নে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের উপস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী এবং আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের (বিয়াক) মধ্যে একটি যৌথ বৈঠকের আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কোনো উদ্যোগেই আশানুরূপ ফল আসছে না।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম সমকালকে বলেন, অর্থঋণ আদালতে যত মামলা, সে তুলনায় বেঞ্চ কম। এতে করে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয়। অনেকে টাকা না দিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে দিনের পর দিন খেলাপি দেখানো থেকে বিরত থাকেন। ফলে এই গ্রাহক অন্য ব্যাংক থেকেও ঋণ নেওয়ার সুযোগ পান। সংশ্নিষ্ট ব্যাংক টাকা আদায়ের জন্য ব্যাপক অর্থের বিনিময়ে আইনজীবী নিয়োগ করে। ঋণ গ্রহীতা একের পর এক সময় নিতে থাকেন। এভাবে বছরের পর বছর মামলা চলতে থাকে। টাকা আদায় হয় না, অথচ ব্যাংকের খরচ বাড়তেই থাকে। যেভাবেই হোক এই দুরবস্থা দূর করতে হবে। মামলাজট কমাতে হবে।
আইন কমিশনসহ অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই বৈঠকে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এমডি খেলাপি ঋণ না কমার প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন মামলার দীর্ঘসূত্রতা। তারা বলেন, আদালতে যাওয়ার অধিকার সবার আছে। তবে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা নানা কৌশলে দীর্ঘসূত্রতা করেন। মূলত তারা ঋণের টাকা ফেরত দিতে চান না। অনেক সময় অর্থঋণ আদালতে কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু রায় পক্ষে না গেলে ওইসব অসাধু ঋণ গ্রহীতা এবার উচ্চ আদালতে যান। আবার উচ্চ আদালতের কোনো বেঞ্চে রায় পক্ষে না এলে ভিন্ন কারণ দেখিয়ে আরেক বেঞ্চে যান। এভাবে বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখেন। সমস্যার সমাধানে খেলাপি ঋণের স্থগিতাদেশের জন্য কেউ আদালতে গেলে নির্দিষ্ট হারে ডাউন পেমেন্টের শর্ত জুড়ে দেওয়া যায় কি-না তা দেখার অনুরোধ করেন ওই এমডিরা। তারা আরও পরামর্শ দেন, এ ছাড়া ঋণখেলাপিদের বিমানে চড়ায় নিষেধাজ্ঞা, দামি গাড়ি চড়তে না দেওয়া, কোনো ধরনের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে না দেওয়ার ব্যবস্থা, পাঁচতারকা হোটেলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। সার্বিক বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়, আদালত, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের একটি প্রতিনিধি দলের মধ্যে যৌথ সভা করার প্রস্তাব এলে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান তাতে সমর্থন জানান।
জানতে চাইলে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণ আদায়ে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। ফলে আইনগত প্রক্রিয়ায় যাওয়ার আগে বিকল্প উপায়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ওপর সামাজিক চাপ তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে এক শাখা ব্যবস্থাপক তাকে বললেন, নানা উপায়ে চেষ্টা করেও একজন গ্রাহককে ধরা যাচ্ছিল না। পরে ওই শাখার ১২ জন কর্মকর্তা দলবেঁধে ওই গ্রহীতার বাসায় যান। সবাই মিলে যাওয়ার পর দেখা গেল আশপাশে খবর হয়ে গেল, তিনি ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তখন তার স্ত্রী, সন্তানরাই টাকা পরিশোধের জন্য চাপ তৈরি করল। এরকম নানা কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, ঋণখেলাপির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আলাদা বেঞ্চ এবং নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা ঠিক করে দেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের অর্থঋণ আদালতে ৫৭ হাজার ৪১৬টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় ব্যাংকগুলোর আটকে আছে এক লাখ ১০ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানার ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ১৯ হাজার ৬৩টি মামলায় আটকে আছে ৪৯ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের ৭ হাজার ৩৯৪টি মামলায় আটকে আছে ২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ২৮ হাজার ৫৮২টি মামলায় আটকে আছে ৫২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ২ হাজার ৩৭৭টি মামলায় আটকে আছে ৫ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। এর বাইরে ব্যাংকের ঋণ বিষয়ে উচ্চ আদালতে ৫ হাজার ৩৭৬টি রিট মামলা রয়েছে। এসব মামলায় জড়িত ৫২ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব রিটের মাধ্যমে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন গ্রাহকরা। ফলে এসব ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে ব্যাংক টাকাও পাচ্ছে না, আবার তাদের ঋণখেলাপি হিসেবে উল্লেখও করতে পারছে না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক সমকালকে বলেন, অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া আছে। যদিও সময়সীমাটা বাধ্যতামূলক না, নির্দেশনামূলক। যে কারণে সবক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়সীমা অনুসরণ করে মামলা শেষ হয় না। তবে এর চেয়ে সময়টা বেশি লাগে অর্থঋণ আদালতের আদেশের ওপর উচ্চ আদালতে রিট হলে। যদিও অন্য দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তিতে যত সময় লাগে, অর্থঋণে সে তুলনায় কম লাগে। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের এক বেঞ্চে কোনো রিট নিষ্পত্তি হলে একই বিষয় নিয়ে আরেক বেঞ্চে যাওয়া যাবে না। তবে একই বিষয়ে ভিন্ন কারণ দেখিয়ে আরেক বেঞ্চে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগ ব্যবহার করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।