ব্যবসা নেই বলেই কিছুদিন আগে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধের ঘোষণা দেন মালিকেরা। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির অভিযোগ, সারা বছর প্রেক্ষাগৃহ সচল রাখার মতো সিনেমা এখন বাংলাদেশে হচ্ছে না। তাই তাঁরা দেশের সিনেমার পাশাপাশি বিদেশি সিনেমা প্রদর্শনেরও অনুমতি চান। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ ঘোষণার পর তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক হয় তাঁদের। তথ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার পর প্রেক্ষাগৃহ বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এবার প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে যতগুলো প্রেক্ষাগৃহ আছে, তা সচল রাখতে হলে এখন বছরে কয়টা সিনেমার দরকার। অনেকেই বলেছেন, বছরে চারটি সুপার–ডুপার ও বাম্পার হিট ছবি হলেই প্রেক্ষাগৃহ চাঙা হবে। আবার কেউ বলছেন, সত্যিকারের পেশাদার প্রযোজক হলে তবেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নেতাদের মতে, বাংলাদেশে এখন আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে সিনেমা নির্মাণ। যে কয়টা সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে, তার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। লোকসান গুনতে গুনতে হতাশ হয়ে পড়ছেন প্রযোজকেরা। আবার আয় নিয়ে সন্তুষ্ট নন প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরা। দেশের বাইরের ছবি প্রদর্শনে রয়েছে কঠোর নিয়ম। তারপরও তাঁদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা শর্ত আর নিয়মকানুন। এভাবে বেশি দিন চলতে পারে না। লোকসান গুনতে গুনতে পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। তাই প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ করে দেওয়ার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন তাঁরা।
বাংলাদেশে দেড় যুগ আগে দেশে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৪৭টি। ২০০১ সাল থেকে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হওয়ার খবর শোনা যায়। মান্নার মৃত্যুর পর হিট ছবির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পায়। আর ঢালাওভাবে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হতে শুরু করে ২০০৮ সাল থেকে। এখন এই সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। শাকিব খানের কিছু সিনেমা হিট হলেও তা প্রেক্ষাগৃহ বন্ধের হার কমাতে পারেনি। জানা গেছে, এখন দেশে ১৭২টি প্রেক্ষাগৃহ আছে। এর মধ্যে ৯০টি প্রেক্ষাগৃহ সারা বছর ছবি প্রদর্শনের উপযোগী। এ ছাড়া ঈদ আর অন্যান্য উৎসবে আরও ৩০-৫০টি প্রেক্ষাগৃহ খোলা হয়।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত দাস বলেন, ‘বাংলাদেশে বছরে কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০টি সিনেমা মুক্তি পাওয়া দরকার। এর মধ্যে ১০-১৫টি সিনেমা মাসব্যাপী ব্যবসা করার মতো অবস্থায় থাকতে হবে। আমি বলতে চাচ্ছি, ১০-১৫টি সিনেমা হিট হতে হবে। তবে সুপার-ডুপার হিট হলে ৫-৬টি সিনেমাই যথেষ্ট।’
সম্প্রতি কয়েকটি ছবির উদাহরণ দিয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির এই নেতা। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে শতভাগ দেশীয় সিনেমার মধ্যে ‘আয়নাবাজি’ ও ‘ঢাকা অ্যাটাক’ টানা ব্যবসা করেছে। এসব সিনেমার মধ্য দিয়ে প্রেক্ষাগৃহে রিপিট দর্শক এসেছে।
২০১৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে অমিতাভ রেজার ‘আয়নাবাজি’ ছবিটি মুক্তি পায়। মুক্তির প্রথম দিন থেকে চঞ্চল চৌধুরী ও নাবিলা অভিনীত এই ছবির প্রতি দর্শকের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। টানা কয়েক মাস বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। সুদীপ্ত দাস বলেন, ‘দেশের পাশাপাশি দেশের বাইরেও ছবিটি প্রদর্শনে সবচেয়ে বেশি সাড়া পাওয়া গেছে। ওই বছর এমন সাড়া আর কোনো ছবির ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি।’ ‘আয়নাবাজি’ মুক্তির ঠিক বছরখানেক পর বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমাটি। এটিও ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য পায়। দেশের বিশাল মধ্যবিত্ত দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করেন ছবিটি দেখতে। রিপিট দর্শক ছিলেন উল্লেখ করার মতো। বহুদিন পর বাংলাদেশের সিনেমায় ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দিয়ে একজন খল চরিত্রের অভিনেতার দাপুটে আগমন ঘটে। তাসকিন রহমান নামের এই অভিনেতা এখন এ দেশের সিনেমার ব্যস্ত একজন তারকা।
সুদীপ্ত দাস বলেন, ‘আগেই বলেছি, বছরে ৬০-৭০টা ছবি হলেই কিন্তু চলে। সংখ্যায় অনেক ছবির দরকার নেই, মানসম্মত ছবি হতে হবে। ব্যবসায়িক মানের দিকে জোর দিতে হবে। আমাদের দেশে কিন্তু একসময় প্রচুর সুপারহিট সিনেমা হয়েছে। এসব সিনেমার কোনোটি ২-৩ মাস টানা প্রদর্শিত হয়েছে। তখন কিন্তু দেশের বাইরের সিনেমার দিকে আমাদের তাকাতে হয়নি। এখন সিনেমা হয় না, আর যে কয়টা হয়, সেগুলো ব্যবসাও করে না। বেশির ভাগ সিনেমার প্রতি দর্শকের আকর্ষণ নেই। হাতে গোনা যে কয়টা ভালো মানের সিনেমা হয়, সেসব দেখতে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমান।’
সুদীপ্ত দাসের মতে, সুপার-ডুপার-বাম্পার হিট হলে কিন্তু বছরে ৩-৪টা সিনেমা মুক্তি পেলেই প্রেক্ষাগৃহ মালিক কোনোমতে বেঁচে যান। সর্বশেষ ভালো ব্যবসা করেছে ‘আয়নাবাজি’ ও ‘ঢাকা অ্যাটাক’। এ ধরনের ছবি প্রেক্ষাগৃহে বারবার দেখেছেন দর্শকেরা। গল্পের বৈচিত্র্য থাকতে হবে। চিত্রনাট্যের শক্ত ভিত থাকতে হবে। গল্প বলার ঢং আকর্ষণীয় হতে হবে। তাহলে দর্শকও প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে আনন্দ পাবেন।
মধুমিতা মুভিজ থেকে দুই ডজনেরও বেশি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এসব ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘আগুন’, ‘দূরদেশ’, ‘মিস লঙ্কা’, ‘নিশান’, ‘আঁধারে আলো’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘অলংকার’। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ প্রথম আলোকে আজ রোববার বলেন, ‘বছরে ৫২ সপ্তাহ। এর মধ্যে ৪০ সপ্তাহে ভালো মানের সিনেমা মুক্তি দিতেই হবে। প্রতি সপ্তাহে দুটি করে সিনেমা হলে বছরে ৮০টি সিনেমা অবশ্যই দরকার। প্রেক্ষাগৃহ চাঙা রাখতে হলে ১৫-২০টি সুপারহিট সিনেমা অবশ্যই দরকার। তাহলেই আমাদের আর বিদেশি সিনেমার ওপর নির্ভর করতে হবে না।’
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, বছরে অবশ্যই ৭০-৮০টি সিনেমা মুক্তি পাওয়া দরকার। এর মধ্যে প্রতি মাসে যদি একটি করে সুপারহিট সিনেমা পাওয়া যায়, তবেই চাঙা হবে প্রেক্ষাগৃহ।
‘আয়নাবাজি’ ছবির পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন অন্যভাবে। বললেন, ‘দেশে চারটি সৎ প্রযোজনা সংস্থা দরকার। প্রযোজক ঠিক থাকলে সিনেমা এমনিতেই হয়ে যাবে। আমাদের কোনো পরিচালকের দরকার নেই, পেশাদার প্রযোজক দরকার। প্রযোজক মানে কিন্তু শুধু অর্থলগ্নিকারী নয়। অর্থ তো ব্যাংক কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া যায়।’
এই দেশে অনেক প্রতিভা আছে বলে বিশ্বাস করেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। এসব প্রতিভাকে ঠিকমতো কাজে লাগানোর জন্য দরকার সৎ প্রযোজক। এই সৎ প্রযোজক বলতে কী বোঝাতে চান? অমিতাভ রেজা চৌধুরী বলেন, ‘সৎ প্রযোজক হচ্ছেন এমন একজন প্রযোজক, যিনি তাঁর পেশা সম্পর্কে খুব ভালোমতো জানেন। তাঁর কাজ হচ্ছে টাকা জোগাড় করা এবং লগ্নি ফিরিয়ে আনা নিশ্চিত করা। চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো প্রযোজনাও একটা পেশা, এটা বুঝতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য হচ্ছে, প্রযোজনা পেশা আমাদের দেশে নেই।’
কিন্তু একসময় যে সিনেমা সুপারহিট কিংবা বাম্পার হিট হয়েছিল, সেটা সম্ভব হয়েছিল কীভাবে? অমিতাভ রেজা চৌধুরী বলেন, ‘সিনেমা যখন সুপারহিট কিংবা বাম্পার হিট হয়েছিল, তখন দেশে সহস্রাধিক প্রেক্ষাগৃহ ছিল। প্রেক্ষাগৃহের যে বাজার ছিল, তা কিন্তু এখন আর নেই। এখন সিনেমার নতুন ডাইমেনশন তৈরি হয়েছে, অর্থ নিরাপদ করার ব্যাপারে। অর্থ নিরাপদ করার যে ব্যাপার আছে, এটা তো নতুন প্রযোজকদের শিখতে হবে, জানতে হবে। ধরা যাক, একজন মানুষ এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, সেটা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেটাকে কীভাবে বাজারজাত করতে হবে এবং আয় করতে হবে, সেই কৌশল প্রযোজককে জানতে হবে। এসব জানতে পারলেই চারজন সৎ প্রযোজকের একজন প্রতি মাসে ১–২টি ছবি বানালেই চিন্তার কিছু নেই।’