জোটসঙ্গী বিএনপি সংসদে যোগ দেওয়ায় নিজেদের নির্ভার মনে করছে গণফোরাম। নিজেদের নির্বাচিত সাংসদেরা আগেই শপথ নেওয়ায় জোট ও জোটের বাইরে বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল গণফোরামকে। দলটির নেতারা বলছেন, এখন বিএনপিকে নিয়ে একসঙ্গে রাজনীতির মাঠে থাকতে পারবেন তাঁরা। আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন।
নির্বাচনের পর থেকেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে এবং নির্বাচিত কেউই সংসদে যাবে না বলে জানায়। অনেক দোলাচলের পর জোটের অন্যতম শরিক বিএনপি শেষ সময়ে এসে গতকাল সোমবার একাদশ জাতীয় সংসদে যোগ দেয়। অবশ্য ২৬ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ায় তখন তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়। তবে গতকাল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই বিএনপি সংসদে গিয়েছে। তবে মির্জা ফখরুল নিজে সংসদে যোগ দেবেন না বলে জানিয়েছেন। এবারের নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট থেকে আটজন নির্বাচিত হন। তার মধ্যে দুজন গণফোরামের এবং বিএনপির ছয়জন। গণফোরামের দুজন শপথ নেন আগে।
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তো মনে হয় বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে। গণফোরামের অবস্থান ছিল, সংসদে গেলে সবাই একসঙ্গে যাবে। না গেলে কেউ না। যার জন্য আমরা আমাদের দুজনকে অপেক্ষা করতেও বলেছিলাম।’ শপথের বিষয়টি ‘গলার কাঁটা’ ছিল উল্লেখ করে সুব্রত বলেন, ‘শপথ নিয়ে গণফোরামের গলায় কাঁটা বিঁধে ছিল। বিএনপির সাংসদেরা শপথ নেওয়ায় হয় সেই কাঁটাটা বের হয়ে গেছে নয়তো ভেতরে চলে গেছে। দলের মধ্যে যে বিব্রতকর অবস্থা, জোটের মধ্যে যে ভিন্নতা বা শপথ নিয়ে যে নানান কর্মকাণ্ড বা সমালোচনা ছিল তার অবসান হয়েছে। এখন সামনের দিনে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি দেওয়া সহজ হবে। আমাদের নিয়ে, সভাপতিকে নিয়ে নানা কথা, সমালোচনা হয়েছে, সেগুলোও এখন কেউ বলতে পারবে না।’
চলতি জানুয়ারিতে গণফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, দলের দুজনের শপথ নেওয়ার ব্যাপারে দল ইতিবাচক। এ ব্যাপারে তাঁরা শিগগিরই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন। ড. কামাল হোসেন তখন বলেন, তাঁদের দুই প্রার্থী নিজেদের অর্জনকে ধরে রেখে অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে গণফোরাম মনে করে। তাঁর এ বক্তব্যের পরেই জোটের মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়। পরদিনই ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বৈঠকে বসে জানান, কেউই সংসদে যাবে না। এর দুই মাস পর দল ও জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রথম শপথ নেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। গণফোরামের সদস্যপদ নিয়ে ও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন তিনি। গণফোরাম তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার করে। সুলতান মনসুরকে নিয়ে তখন নানান সমালোচনাও হয়। এরপর গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোকাব্বির খানও শপথ নেন। মোকাব্বির খানের বেলায় ব্যবস্থা নিতে সময় নেয় গণফোরাম। গণফোরামের দুজন চলে যাওয়ায় জোটের শরিক বিএনপিসহ অন্যদের সমালোচনার মুখে পড়েন গণফোরামের নেতারা। তাঁদের কাউন্সিলে মোকাব্বির খানের মঞ্চে বসা নিয়ে দলের মধ্যেই ক্ষোভ শুরু হয়। শপথ ইস্যুতে সমালোচনা গণফোরামের পিছু ছাড়েনি।
দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেওয়ায় গণফোরামের সাংসদ মোকাব্বির খানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর ব্যাপারে সুব্রত চৌধুরী বলেন, মোকাব্বিরের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।
তবে বিএনপি দলীয়ভাবে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে, তা দলের অনেক নেতা এবং জোটের শরিকেরাও জানত না। শপথের পর ঐক্যফ্রন্টের অন্যরা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব লিখিত এক বক্তব্যে জানান, ভোট ডাকাতি করে এবারের নির্বাচন হয়েছে। সেখানে পাঁচ–ছয়জন শপথ নিলেই সংসদের বৈধতা হবে না। তিনি আরও বলেন, ভোট ডাকাতির সংসদ জনগণের সংসদ হবে না, গণতন্ত্র-ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বরং গণতান্ত্রিক শক্তি আরও ঐক্যবদ্ধ হবে, নতুন করে পুনর্গঠিত হবে।
ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া থেকেই যুক্ত ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি চিকিৎসক জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সংসদে গিয়ে কথা বলার পক্ষেই ছিলাম। তবে যে পদ্ধতিতে যাওয়া হয়েছে সেটা ভুল। সিদ্ধান্ত সঠিক কিন্তু পথটা ভুল। বিএনপির স্থায়ী কমিটি এবং সবাইকে জানিয়েই করতে পারত।’ তবে বিএনপি সংসদে যাওয়াতে রাজনীতিতে একটা প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি। ঐক্যফ্রন্টও এখন একসঙ্গে কর্মসূচিতে সক্রিয় হতে পারবে। জাফরুল্লাহ বলেন, এখন সরকার যদি খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে আপত্তি না জানায়, তাহলে রাজনীতির জন্যই তা ভালো হবে।