একবার জ্বলছিল, একবার নিভছিল লাল-নীল বাতিগুলো। বাদ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে অমন জ্বলা-নেভাই যেন সেগুলোর দায়িত্ব। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছিল গিটারিস্ট লাবু রহমানকে। কাঁচা-পাকা চুলের মানুষটি তেমন বদলাননি। বদলেছে কেবল তাঁর মাথার কালো চুলগুলো। সাদা হয়েছে অনেকটা, বাকি রয়েছে কিছু। তবে আট আঙুলে দুটো কিবোর্ড বাজিয়ে চলা ফোয়াদ নাসের বাবুর মুখে বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। দলের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, কান্ডারিরা কি আর তা এড়াতে পারেন? ফিডব্যাক, গত শতকের সত্তরের দশকের ব্যান্ড। কত ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে চার দশক পেরিয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটির রাজদর্শন মিলনায়তনে ছিল ফিডব্যাকের চার দশক পূর্তি কনসার্ট ‘ফোর ডিকেডস অব ফিডব্যাক’। গান শোনায় পুরোনো ফিডব্যাক, নতুন ফিডব্যাক আর ফিডব্যাক ছেড়ে গড়া মাকসুদুল হকের নতুন দল—ঢাকা। অতীতের স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে পুরাতন সদস্যদের নিয়ে মঞ্চে এসেছিল ফিডব্যাক। দলটির প্রথম রেকর্ড করা গান ‘একদিন সেই দিন’ গেয়ে শুনিয়েছেন মাকসুদুল হক। সে সময় মঞ্চে ফোয়াদ নাসের বাবু, রোমেল খান, সেলিম হায়দার ও মন্টু। বহুকাল আগের মুমূর্ষু স্মৃতি জাগিয়ে তোলে গানটি। দর্শকসারিতে চোখে পড়ে বয়স্ক অনেককে, আশির দশকে যাঁরা ছিলেন কিশোর বা তরুণ।
বিরতি দিয়ে মঞ্চে আসে এখনকার ফিডব্যাক। ফোয়াদ নাসের বাবু, লাবু রহমান, লুমিন, টন্টি ও রায়হান আল হাসান। ভাঙা-গড়ার যুদ্ধে এখনো টিকে আছেন এ সদস্যরা। এ বেলায় রায়হান ও লুমিন গেয়ে শোনান ‘ভীরু মন’, ‘এই পথে গেছ তুমি’সহ বেশ কয়েকটি গান। তরুণ শ্রোতাদের চেনা গান এগুলো। তবে ফিডব্যাকের সঙ্গে যখন মাকসুদের নতুন ব্যান্ড ঢাকা মঞ্চে আসে, কনসার্টের সেই অংশটুকুই যেন হয়ে ওঠে সেরা মুহূর্ত। মাকসুদের কণ্ঠে স্মৃতি তাড়া করে ‘চিঠি’, ‘মৌসুমী’, ‘মাঝি’, ‘একদিন সেই দিন’ গানগুলো। একটি গান ও তার বিরতির ফাঁকে হুইসেলের মতো শিস বেজে ওঠে। দেখা যায় টেকো মাথা, কানের দুপাশে পাকা চুলের মাঝবয়সী এক শ্রোতাকে। গানগুলো শুনে বিগত তারুণ্যের উত্তেজনা আটকে রাখতে পারেননি তিনি।
চল্লিশ পার করা ফিডব্যাকের সম্মানে এ কনসার্টে গান করে ওয়ারফেজ, মাইলস, আর্টসেল, দলছুট। ওয়ারফেজ গেয়ে শোনায় ফিডব্যাকের ‘মৌসুমী’, মাইলস শোনায় ‘টেলিফোনে যখন ফিসফিস’ গান দুটি। আর্টসেল নিজের গানই শুনিয়েছে। তাঁদের উপস্থিতি বিশেষভাবে স্পন্দিত করে তরুণ শ্রোতাদের। উচ্ছ্বাসে তাঁরা সমস্বরে গাইতে শুরু করে দলটির একটি গান। আর্টসেল শুনিয়েছে তাদের ‘জন্মেছি এই বাংলাদেশে’ গানটি। গান শুরু করার আগে ওয়ারফেজের শেখ মনিরুল আলম টিপু বলেন, ‘আমাদের অনুপ্রেরণা ফিডব্যাক। পরম ভালোবাসার ব্যান্ড এটি।’ আর মাইলসের শাফিন আহমেদ শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘ফিডব্যাকের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে যাত্রা করেছিল মাইলস।’ সেই কথার সূত্র ধরে হামিন আহমেদ বলেন, ‘একটি দলের বেশ কয়েকটি গান হিট হয়ে গেল, এ এক বিরল ঘটনা।’
ফিডব্যাকের গিটারিস্ট লাবু রহমান বলেন, ‘শ্রোতাদের কারণেই আমরা আজ এত দূর আসতে পেরেছি।’ তাঁর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ফোয়াদ নাসের বাবু দলের সার্থকতার কৃতিত্ব দেন ভক্তদের। আর মাকসুদ, প্রতিবার মঞ্চে এসে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁদের শুভেচ্ছা জানিয়ে গাইতে আসা দলগুলোর সঙ্গে। ছোট ছোট করে বলছিলেন, নিজের কথা, পুরোনো দিনের স্মৃতির কথা। গান শুরু করার আগে বলেন, ‘মৌসুমী গানটা কীভাবে যে এত জনপ্রিয় হয়ে গেল আজও বুঝিনি।’ গানটির লেখক কাউসার আহমেদ চৌধুরী এসেছিলেন কনসার্টে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশিক্ষণ থাকা হয়নি মানুষের ভাগ্য বলে দেওয়া এই জ্যোতিষীর।
একটা সময় কিচ্ছু ছিল না ফিডব্যাকের। ছিল কেবল বুকভরা স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে একটা গানের দল যাত্রা করেছিল ৪০ বছর আগে। খোকা ভাইয়ের (হাফিজুল আলম) ধারের টাকায় গুটি গুটি পায়ে এগিয়েছে। একসময় হয়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড। পেছনে ফিরে আজ পুরোনো দিনের গানগুলো গেয়ে উঠলেন ফিডব্যাকের সেদিনের শিল্পী মাকসুদ। মনিটরের ওপর এক পা তুলে মাথায় লাল গামছা বাঁধা মাকসুদ সুরে সুরে ফিরে ফিরে যেতে চাইছিলেন অতীতে। ‘চোখে জলে ভেজা স্যাঁতসেঁতে’ গানটি খানিকটা পেছনে নিয়ে যেতে পেরেছিল তাঁকে। এ সময় মিলনায়তন ছিল অন্ধকার। মাকসুদের আহ্বানে একসঙ্গে কেবল জ্বলছিল আর অন্ধকারে ভাসছিল শ্রোতাদের ফোনের বাতিগুলো।
তবে রাজদর্শন মিলনায়তনে সাউন্ড সিস্টেম ছিল অত্যন্ত হতাশাজনক। এই মিলনায়তনে কনসার্টের আয়োজন করার আগে আয়োজকদের আরও খানিকটা ভাবনার প্রয়োজন ছিল। এ কনসার্টের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে প্রাণ গ্রুপ।
সত্তরের দশকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ইংরেজি গানে শুরু একদল যুবকের। ‘টুয়েন্টিনথ সেঞ্চুরি’ নামে যাত্রা করেছিল দলটি। পরে ১৯৭৬ সালে নাম বদলে তারা হয়ে যায় ফিডব্যাক। ইংরেজি গানের বদলে জমতে শুরু করে নিজেদের মৌলিক গান। তারপরের কাহিনি ভক্তদের জানা।