মান-অভিমান ভুলে বা ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ট্রাইব্যুনালে যৌতুকের মামলা করে যাঁরা আফসোস করছিলেন, অথচ বেরোনোর পথ পাচ্ছিলেন না, হাইকোর্ট তাঁদের জন্য একটি নতুন জানালা খুলে দিয়েছেন।
গতকাল ১২ মে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ তাঁদের এ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ রায়টির (গত ১০ এপ্রিল রায় হয়) পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশ করেছেন। এর ফলে ২০০০ সালের নারী নির্যাতন দমন আইনের ১১ গ ধারাটি আপসযোগ্য হলো। ১১ গ ধারা বলেছে, যৌতুকের কারণে ‘সাধারণ জখম (simple hurt) করার জন্য অনধিক তিন বছর কিন্তু অন্যূন এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন৷’
দেশের ৬৪ জেলার ৫৮টি নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে বিচারাধীন থাকা ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৫১ মামলার মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগ মামলাই উল্লিখিত ১১ গ ধারার আওতায় দায়ের করা হয় বলে ধারণা করা হয়।
বর্তমানে এই বিধানের ফলে স্বামী-স্ত্রী মিলে গেলেও তাঁরা আপস করে মামলা তুলে নিতে পারেন না। ৬ মাসের মধ্যে সংসদকে আইন সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট অপরাধকে অনাপসযোগ্য থেকে আপসযোগ্য করতে বলেছেন।
মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সতর্কতার সঙ্গে হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানান। কারণ তিনি মনে করেন, ১১ গ ধারায় স্ত্রী সাধারণ জখমের শিকার হলে তিন বছর, কিন্তু ওই একই আইনের ১১ খ ধারায় স্ত্রী মারাত্মক জখম হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান আছে। তাই বাস্তবে এমনিতেই এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে যে, পুলিশ ও চিকিৎসককে বিপথগামী করে মারাত্মক জখমের পরিবর্তে সাধারণ জখম লিখিয়ে নেওয়া হয়। এ জন্য ২১ দিন হাসপাতালে ভর্তি না রেখে তার আগেই ভুক্তভোগীকে অনেক সময় হাসপাতালছাড়া করা হয়।
আইনে এটা মীমাংসিত যে, আহত হয়ে টানা ২১ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকলে সেটা মারাত্মক জখম অর্থাৎ সাজা যাবজ্জীবন আর তার কম হলে সাধারণ জখম অর্থাৎ সাজা ৩ বছর। এখন ১১ গ আপসযোগ্য হলে ২১ দিনের আগে হাসপাতালছাড়া করার প্রবণতা যেন আরও তীব্র না হয়।
উল্লেখ্য, সংসদে অনুরূপ সংশোধনী আনার আগ পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের আলোকেই নিম্ন আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন। অর্থাৎ যা আইনে নেই, সেই শূন্যতা পূরণ করবে হাইকোর্টের রায়।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মো. শফিকুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র মামলায় যে পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছেন, তাতে বলা হয়, ‘যৌতুকের দাবিসহ যেকোনো অজুহাতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর ওপর শারীরিক নির্যাতন নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় এবং গর্হিত অপরাধ। এতদসত্ত্বেও ওই অপরাধ সংঘটনের পর যদি স্বামী ও স্ত্রী নিজেদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে দাম্পত্য জীবন অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করেন বা রাখেন, সে ক্ষেত্রে আইনের বিধান যত কঠিনই হোক না কেন, একটি সংসার রক্ষা করার চেয়ে সেটি বড় হতে পারে না। একটি সংসার ভেঙে গেলে তার পারিবারিক ও সামাজিক নেতিবাচক দিক সুদূরপ্রসারী।
এতে শুধু স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই ঘটে না, তাঁদের সন্তান এমনকি নিকট আত্মীয়স্বজনের ওপরেও এর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা পূরণ করা খুব কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। এই বাস্তবতায় আমাদের উচিত হবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত (to secure ends of justice) করার স্বার্থে অত্র মামলায় বর্তমান বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে একটি সংসার ও দরখাস্তকারী-অভিযোগকারিণীর শিশুসন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ ক ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পক্ষদ্বয়ের আপসের অভিপ্রায়কে গুরুত্ব দিয়ে দণ্ডিত দরখাস্তকারীর দণ্ড বাতিল ও সাজা মওকুফ করা।’
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শফিকুল ইসলামকে ৩ বছরের কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন। দণ্ডিত স্বামী ওই রায় বাতিলে ৫৬১ ক ধারার আওতায় হাইকোর্টে মামলা করেন। ২০১২ সালে লাভলী আক্তার মামলা করেন, নৌবাহিনীর ঈসা খাঁ ঘাঁটিতে কর্মরত স্বামী তিনি গর্ভবতী থাকতে চার লাখ টাকার যৌতুক দাবিতে তলপেটে লাথি মারেন। এতে তিনি গুরুতর জখম হন। তাঁর অকাল গর্ভপাত ঘটে। এরপরও নির্যাতন অব্যাহত রাখেন। এই মামলায় স্বামী দোষী সাব্যস্ত হন। দণ্ডিত শফিকুল ২০১৬ সালে প্রথমে ট্রাইব্যুনালে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন এবং পরে হাইকোর্টে আসেন। হাইকোর্টের রুল জারির পর স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে হলফনামা দেন যে, ‘তাঁদের মধ্যে সকল ভুল-বোঝাবুঝির অবসান’ হয়েছে। এখন তাঁরা সুখে জীবন যাপন করতে চান। আড়াই বছর বয়সী তাঁদের এক পুত্রসন্তান আছে।
হাইকোর্ট চট্টগ্রামের ট্রাইব্যুনালের ওই রায় বাতিল করে বলেছেন, আইনের প্রয়োগ ও এর ব্যাখ্যা যান্ত্রিক হতে পারে না। পারিবারিক বা দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ও ভুল-বোঝাবুঝি অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।