এবারের বিশ্বকাপে রোববার বাংলাদেশের প্রথম খেলাকে কেন্দ্র করে লন্ডন ও ওভালের বিভিন্ন এলাকায় ছিল লাল সবুজের ছড়াছড়ি। লাল সবুজের জার্সি পরা সমর্থকদের জটলা ছিল সব জায়গায়।
খেলা শুরুর আগ থেকেই ওভাল অভিমুখে শুরু হয় এই লাল সবুজের মিছিল। রোববার ছুটির দিন হওয়ায় এই মিছিলে টাইগার সমর্থকদের সংখ্যা ছিল বেশি। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে কিশোর কিশোরী, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ সবার উপস্থিতি ছিল।
যারা সরাসরি স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখতে পারেননি, তারা খেলার পুরো সময়টা ছিলেন বাসায় টিভির সামনে। লন্ডনের যেসব এলাকায় রয়েছে বাংলাদেশিদের বসবাস, সেসব এলাকার বাসা বাড়িতে অবস্থানরত লোকজনও শুনেছেন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ রব। ওভালে যাওয়া হয়নি বলে কি হয়েছে, টিভি সেটের সামনে লাল সবুজের জার্সি পরে মা, বাবা, ভাইবোন সবাই মিলেই তৈরি করেছিলেন একেকটি ওভাল।
অনেকে দল বেধে বন্ধু, স্বজনের বাসায় বসে উপভোগ করেছেন বাংলাদেশের খেলা। বাঙালি পাড়া হিসাবে খ্যাত লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারায়, বিশেষ করে ইস্ট লন্ডনে, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে টিভি স্ক্রিনে লাইভ খেলা উপভোগ করেছেন বাঙালিরা।
ব্যস্ততম শহর লন্ডনে মুঠোফোনেই অনলাইনে অনেকে খেলা দেখেছেন। কাজের বাধ্যবাধকতা এবং সময় দুটোর মাঝখানে মুঠোফোনের স্ক্রিনে প্রবাসীদের চোখ ও মন ছিলো আটকে। ট্রেনে, বাসে, হেঁটে হেঁটে অথবা কাজের ফাঁকে রোববারের পুরো দিনটি ছিল ক্রিকেটময়। দর্শক গ্যালারি থেকে যখন আওয়াজ উঠছিলো বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, তখন অবাঙালি দর্শকরাও এই আওয়াজে নিজেদের কন্ঠ মিলিয়েছেন, বলেছেন, ‘ওভালতো বাংলাদেশের হোম গ্রাউন্ড।’
টাইগার ভক্তরা নিজ দেশের ব্যানার-ফেস্টুন, মুখে আলপনা আর বাংলাদেশের জার্সি গায়ে হাজির হন ওভালে। আর ওভাল স্টেডিয়ামের সামনে দেখা যায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ইংল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের পতাকা বিক্রি করছেন অনেক ব্রিটিশ নাগরিক। শুধু পতাকা নয়, তাদের হাতে ছিল লাল-সবুজের মিশ্রণে বাংলাদেশের নামাঙ্কিত মাফলার। আর মাথায় ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ক্যাপ।
টাইগারদের হুঙ্কারে সাউথ আফ্রিকা যে ওভাল ছাড়ছে, খেলার শেষ দিকে প্রায় সব দর্শকই এটি নিশ্চিত হয়ে উঠেছিলেন। এরপরও টাইগারদের করা ৩৩০ রানের জবাবে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ৩০৯ রানে হেরে যাওয়ার পর প্রায় ১৬ হাজার বাংলাদেশি দর্শকসহ পুরো দর্শক গ্যালারিই বিজয়ে উল্লসিত মেতে ওঠেন।
ব্রিটেনে বাংলাদেশের প্রধান ব্যবসা সেক্টর হলো কারী রেস্টুরেন্ট। খেলা শেষে রোববার সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টগুলোর অনেক গ্রাহক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে আলোচনা করেন। ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ড যেন হয়ে উঠেছিলো একখণ্ড বাংলাদেশ।
লন্ডনে বসবাসরত বিশিষ্ট গল্পকার মোহাম্মদ হোসেইন ছেলেসহ খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। ওভাল থেকে ফিরে তার ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘জয়ের আনন্দ নিয়ে মাঠ ছাড়তে-ছাড়তে ভাবলাম- কে বলেছে- দেশের মানুষের দেশপ্রেম নেই, এসে দেখো, দেশের পতাকাটা উড়াতে-উড়াতে, ঘামতে-ঘামতে, চিৎকার করতে-করতে কীভাবে একটা দেশকে জয়ী করতে হয়, দেখো। ভাবলাম- দলকে জেতাতে গিয়ে বাঙলি যেভাবে পাগল হয়ে উঠেছে, ৭১এ কেমন ছিল তারা? যখন দেশকে শত্রু মুক্ত করতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে নিশ্চয় উন্মাদ হয়ে উঠেছিল তারা। এটা দেখেই বুঝতে পারি। আর কে বলেছে- আমাদের দেশপ্রেম নেই। দেশ-দেশ বলে এদেশের মানুষ ঘেমে উঠছে, জেগে উঠছে, হেসে উঠছে। যে কজন হাতেগোনা খারাপ লোক আছেন, দয়া করে ভাল হয়ে যান। দেশ জিতলে আমরা জিতি। এখন শুধু জয়ের দিন। আনন্দের দিন। বাঙলির জেগে উঠার দিন। ভালবাসায় পাগল হবার দিন। নাকি? জেগে উঠো ভাই। জেগে উঠো বোন। দেশ গড়তে হবে। এবং এখন-ই।’
লন্ডনে বসবাসরত প্রবীন সাংবাদিক আবু মুসা হাসান তার পরিবার নিয়ে গিয়েছিলেন খেলা দেখতে। বললেন, ‘এর আগে বাংলাদেশের ম্যাচ দেখে এতো মজা পাইনি। রেকর্ড সর্বোচ্চ ৩৩০ রান করে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে শুভ সূচনা করেছে। প্রথম ম্যাচের কিছু ভুলত্রুটি শোধরে ৫ জুন বুধবার দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে নিউজিল্যান্ডকে হারানো সম্ভব বলে আমি মনে করি। দ্বিতীয় ম্যাচেও ওভালে গিয়ে গলা ফাটিয়ে প্রিয় বাংলাদেশ দলকে সমর্থন দেয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত।’
রোববারের খেলাকে কেন্দ্র করে আসলে ঈদের আগেই ঈদ আনন্দ উপভোগ করেছেন ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। বিশ্বকাপের শুরুতেই যে আনন্দের জোয়ারে ভাসছেন শিকড় বিচ্ছিন্ন প্রবাসী এই মানুষগুলো, এটিই এবার তাদের ঈদ আনন্দ। ‘আজ ঈদ, মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ’-পাঠ্য বইয়ের ওই গল্পের মতো অনেকটা এরকম, ‘আজ ক্রিকেট সাফল্যের দিন, বাঙালির ঘরে ঘরে আনন্দ।’