ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আলোচিত-সমালোচিত ডিআইজি মিজানুর রহমান এখনও স্বপদেই বহাল রয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সাসপেন্ডের মতো প্রাথমিক কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। যদিও এরই মধ্যে ঘুষগ্রহীতা দুদকের পরিচালককে সাসপেন্ড (সাময়িক বরখাস্ত) করা হয়েছে। অন্যদিকে বহাল তবিয়তে স্বপদে থেকে ডিআইজি মিজান প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে ঘুষ দেওয়ার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমন প্রেক্ষাপটে বিপাকে পড়েছেন পুলিশের নীতিনির্ধারকরা। বিব্রতবোধ করছেন পুলিশ বিভাগের সৎ ও আন্তরিক কর্মকর্তারা। ক্ষোভ দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে।
দ্বিতীয় বিয়ে গোপন রাখার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে গত বছর ডিআইজি মিজানকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে প্রত্যাহারের পর পুলিশ সদরদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করা হয়। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনও পাঠানো হয়। কিন্তু মিজানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদনটি এখনও লালফিতায় বন্দি হয়ে আছে। এরই মধ্যে দুদকের অভিযোগ থেকে বাঁচতে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন মিজান।
এ ঘটনায় ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী গতকাল বলেন, সংশ্নিষ্টদের তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করতে বলা হয়েছে। এর পর তদন্ত কমিটি গঠনের প্রসঙ্গ আসবে। ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পুলিশ সদরদপ্তর সাসপেন্ড করতে পারে না। এর এখতিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
আগের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডিআইজি মিজানের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নে আইজিপি বলেন, পুলিশ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। তার ব্যাপারে পুলিশ সদরদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক আগেই পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সে বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখবে।
তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে জানতে স্বরাষ্ট্র সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (পুলিশ ও এনটিএমসি) মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, ঘুষ লেনদেনে জড়িত দুই পক্ষই সমানভাবে দায়ী। অথচ এখনও পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নারী নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো গুরুতর অভিযোগ থাকার পরও ডিআইজি মিজান স্বপদে বহাল রয়েছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাধারণ মানুষ সেবা পাওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়। তাদের ঘুষ দিতে জিম্মি করা হয়। এ ধরনের সাধারণ ঘুষদাতার সঙ্গে ডিআইজি মিজানকে মেলালে চলবে না। কারণ, মিজান ঘুষ দিয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে। অভিযোগের খড়্গ থেকে বাঁচতে। তার সঙ্গে দুদক কর্মকর্তাও সমভাবে দায়ী। পরস্পর যোগসাজশে তারা ঘুষ লেনদেন করেছেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যে কোনো অভিযোগ উঠলে, দ্রুত সেটির নিষ্পত্তি না করলে তা অপরাধীকে সুরক্ষা দেওয়ার শামিল। ডিআইজি মিজান আগে যে ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন, সেটির সুরাহা দ্রুত হওয়া উচিত ছিল।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট শাহ্দীন মালিক বলেন, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে আগে যে অভিযোগ উঠেছে সেটা এত দিনেও নিষ্পত্তি না হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত। এত দীর্ঘ সময় এসব ঘটনা ঝুলে থাকলে জনমনে সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না- এটাই প্রমাণ হয়।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির গতকালও দাবি করেছেন, ‘ঘুষের অভিযোগ মিথ্যা’। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, ‘যত প্রকারের বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের নিয়ে প্রমাণ করেন। মিথ্যার কোনো প্রমাণ থাকে না। ঘুষ লেনদেনের অডিওতে ব্যবহূত কণ্ঠও বানোয়াট।’
তবে ডিআইজি মিজান গতকাল সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ঘুষ দেওয়ার সব রেকর্ড তার কাছে রয়েছে। কমিশন থেকে ডাকা হলে তিনি উপস্থাপন করবেন। ঘুষ দিতে তাকে বারবার চাপ দেওয়া হয়েছে।
মিজান বলেন, ‘যখন দেখলাম দুদকের এই লোকটা নিজেই দুর্নীতিবাজ, তখন সেটা তো প্রমাণ করতে হবে। এই বিষয়টাই প্রমাণ করেছি। ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়েছি। স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। এসবের তথ্য-প্রমাণ আছে। যথাসময়ে অনুসন্ধান কমিটিকে এগুলো দেব।’
পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এর আগে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও ঘুষ দেওয়ার ঘটনার পর মিজানের ব্যাপারে নতুনভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে এ-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি গঠন করা হতে পারে।
পুলিশের একটি বড় অংশের ভাষ্য, এবারও ডিআইজি মিজান পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন। দুদক কর্মকর্তাকে ফাঁদে ফেলে তিনি হয়তো একটি প্রতিষ্ঠানের কোনো ব্যক্তিবিশেষের নেতিবাচক দিক সামনে আনতে পেরেছেন; তবে তার উদ্দেশ্য ও এর প্রয়োগপদ্ধতি নৈতিক নয়। তিনি নিজে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতে ঘুষ দিয়েছেন। মিজানের এই দায় ব্যক্তিগত- এটা পুলিশ বাহিনী নিতে চায় না। পুলিশের অনেকেই চান, শিগগিরই তদন্তসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হোক। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হলে জনমনে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি হবে না বলে মনে করেন তারা।
এর আগে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি ব্যাংক কর্মকর্তা মরিয়ম আক্তারকে ৫০ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে করেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি বিষয়টি গোপন রাখার শর্ত দেন। মরিয়ম স্ত্রীর স্বীকৃতি চাওয়ায় ক্ষিপ্ত হন তিনি। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর পুলিশ পাঠিয়ে মরিয়মকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া মগবাজার কাজি অফিসের কাজিকে দিয়েও মামলা করান তিনি। প্রায় তিন সপ্তাহ পর কারাগার থেকে ছাড়া পান মরিয়ম। এরপর এক টেলিভিশন উপস্থাপিকার সঙ্গে ঝামেলায় জড়ান মিজান। সংবাদ পাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি রয়েছে।
গত বছরের ৩ মে অবৈধ সম্পদসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে মিজানুরকে দুদক কার্যালয়ে প্রায় সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর মিজান ও তার প্রথম স্ত্রী সোহেলিয়া আনারের আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদের খোঁজ পায় দুদক।