বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে তা হবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পরিপন্থি।
আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০) বাজেট ঘোষণার আগে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ মন্তব্য করেন।
দেবপ্রিয় বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে- ঘুষ, অবৈধ আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তির প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর পর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে তা হবে ইশতেহারের ব্যত্যয়।
মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সিপিডি ‘জাতীয় অর্থনীতির পর্যালোচনা ও আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গ’ শিরোনামে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মূল প্রবন্ধের ওপর নিজের বিশ্নেষণ তুলে ধরার পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এ সময় সংলাপ পরিচালক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফসহ গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে যে, আগামী অর্থবছরে সরকার উৎপাদনমুখী শিল্পে বিনিয়োগের জন্য ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিতে পারে। যদিও কয়েক বছর ধরে আবাসন খাতে বিনিয়োগে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে সামগ্রিক শিল্প খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এর আগে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান দুই বছরের জন্য যে কোনো শিল্পে কালো টাকা বিনিয়োগ করে সাদা করার সুযোগ দেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সমান জিডিপি আছে বিশ্বের এরকম অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। তবে ব্যক্তি বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, রফতানি এবং মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর মতো সামাজিক বিভিন্ন সূচকে আশানুরূপ অগ্রগতি নেই। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে উন্নয়নের অন্যান্য সূচকে বৈসাদৃশ্য আছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি থেকে যে ধরনের অর্থনীতি ও উন্নয়ন চিত্র আসার কথা, তা আসছে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ গত ১০ বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির চাপের মুখে রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের শক্তি ছিল। সেই শক্তিতে চিড় ধরেছে। এক ধরনের দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে কর আহরণে অপারগতা। কম রাজস্ব দেশের উন্নয়নে একটা অমোচনীয় প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতির উন্নতি করা না গেলে উন্নয়নের যে অভিলাষ তার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সম্ভব হবে না। আর বিকল্প উৎস থেকে বিনিয়োগের চেষ্টা করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কর আহরণ করতে না পারায় উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি বাস্তবায়ন হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্ধেক বাস্তবায়ন হচ্ছে শেষ তিন মাসে।
বৈদেশিক লেনদেনেও বর্তমানে সবচেয়ে বেশি চাপ রয়েছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি ভালো। তা সত্ত্বেও উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বাড়ছে। চলতি হিসাবে ঘাটতি সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দ্রুত কমে আসছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আট মাসের আমদানি দায় মেটানোর সমপরিমাণ ছিল, যা বর্তমানে পাঁচ মাসে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে টাকা স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। টাকাকে এভাবে স্থিতিশীল রাখা এখন আর যৌক্তিক পর্যায়ে নেই। বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। সরকার মনে করে, টাকার মান কমে গেলে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়বে, যা মূল্যস্ম্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে।
সিপিডি মনে করছে, মূল্যস্ফীতি বর্তমানে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যেহেতু মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেহেতু এখন টাকার মান কিছু কমলে তা সহ্য করার শক্তি অর্থনীতির আছে। টাকার মান পুনর্নির্ধারণ অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করছে সিপিডি।
ব্যাংক খাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ খাতের সংকট জাতীয় উপলব্ধিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। তবে প্রতিক্রিয়াতে নেই। বর্তমান সরকার আসার পর যে কয়টি পদক্ষেপ নিয়েছে প্রতিটি পদক্ষেপ ব্যাংকিং খাতের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকারক হয়েছে। খেলাপি ঋণ ১ টাকাও বাড়বে না- তার বদলে ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। সুদের হার নিয়ে নাড়াচাড়া করে ব্যাংকিং খাতের সংকট সমাধান হবে না। সুদ সুবিধা দিলে গ্রাহকরা কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে দিয়ে যাবে, এটা ভুল তত্ত্ব। কাঠামোগত উন্নয়ন, সুশাসন নিশ্চিত করা ও তসরুফকারীদের শাস্তি না দিলে ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট দেখা দেবে। এখন তারল্য সংকট দেখা গিয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটা পর্যায়ে ছিল। সেখান থেকে উত্তরণের মাধ্যমে বর্তমানে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। সামনে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর হবে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ এখন একটা সীমান্তরেখাতে এসেছে, যেখানে দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মূল প্রবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ২০১২-১৩ অর্থবছরের পর বাজেট বাস্তবায়নের হার কমে গেছে। আগে বাজেটের ৯৫ থেকে ৯৮ ভাগ বাস্তবায়ন হলেও তা বর্তমানে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে সরকারি ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ছে না। সরাসরি কর আহরণ বাড়ছে না। ফলে ঘাটতি অর্থায়নের বড় অংশ আসছে সঞ্চয়পত্র থেকে। এনবিআর বলছে- ৫০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ কম হবে। সিপিডি মনে করে, এই ঘাটতি ৮৫ হাজার কোটি টাকা হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের গতিপ্রকৃতি একরকম নয়। সুশাসনের অভাব পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা। যে কারণে অনেক উদ্যোগ নেওয়ার পরও বিনিয়োগকারীরা তার সুফল পাচ্ছে না।
প্রত্যেক কৃষককে ৫ হাজার টাকা দেওয়ার সুপারিশ: ধানের ন্যায্য দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে সিপিডি। সংস্থাটি হিসাব করে দেখিয়েছে, এতে সরকারের ব্যয় হবে ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ১ কোটি ৮০ লাখ কৃষকের ব্যাংক হিসাবে টাকাটা সহজে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগও রয়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কৃষককে ৯ হাজার কোটি টাকা দিতে কোনো সমস্যা নেই। এটা দিলে তা যুক্তিযুক্ত ও সাম্যবাদী আচরণ হবে।
তিনি বলেন, এ বছর ধানের দাম নিয়ে কৃষকের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এরকম অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার প্রকট চিত্র অন্য খাতে দেখা যায়নি। তাই কৃষক ভর্তুকি দাবি করতেই পারে। তিনি বলেন, ধানের দাম না পাওয়ায় গ্রাম থেকে উদ্বৃত্ত শহরে এসেছে। শহর থেকে তা বিদেশে চলে যাচ্ছে।
এর আগে তৌফিকুল ইসলাম খান বিশ্নেষণ করে দেখান, বোরো মৌসুমে কৃষকের ধান উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে। তিনি বলেন, হঠাৎ কৃষি খাতে মজুরিও বেড়ে গেছে। এটা সামাল দিতে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে।
বিজেএমসির কারখানা বন্ধের প্রস্তাব: সিপিডি বলেছে, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। সংস্থাটি তার উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪১ ভাগ ব্যবহার করতে পারছে। অন্যদিকে ব্যক্তি খাতের পাটকলগুলো বাজারে থাকায় প্রতিযোগিতায়ও বিজেএমসি মার খাচ্ছে। এজন্য এসব কারখানার উৎপাদন ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। সম্পদ, জমি অন্যান্য খাতে শিল্পে ব্যবহারের জন্য দেওয়া যেতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অন্য খাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সরকারের বাজেটে চাপ কমবে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়ানো: সিপিডি শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি দেশের চর ও হাওর অঞ্চলসহ পিছিয়ে পড়া এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিতে বলেছে। স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়ানোসহ ডায়াবেটিক, হৃদরোগের মতো সমস্যা দূর করতে বিশেষ বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছে। একই সঙ্গে সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছে সিপিডি।
১০ সুপারিশ: সামগ্রিক পর্যালোচনা শেষে সংস্থাটি সরকারের কাছে ১০টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজস্ব আহরণের দুর্বলতা দূর করা। তা না হলে ভবিষ্যতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বড় প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে। সরকারি ব্যয়ে শৃঙ্খলা আনা, কর ছাড় কমিয়ে আনার পাশাপাশি কোন খাতে কী কারণে কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট করা। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের বর্তমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে সুদহার কমাতে হবে। কেনার সীমাও কমানোর পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। নতুবা ব্যাংক আমানত পাবে না, ঋণের সুদহারও কমবে না। পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর হওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।