টানা এক বছর ধরে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থাকা রুহুল কবির রিজভী অসুস্থতার মধ্যে দুঃসহ একটি দিন কাটালেন।
দুদিন ধরে অসুস্থ রিজভী স্যালাইন নিয়ে ওই কার্যালয়ের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে রয়েছেন।
এর মধ্যে ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দেওয়ায় বিক্ষুব্ধরা মঙ্গলবার দুপুর থেকে ওই ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলে প্রচণ্ড গরমে তার মধ্যেই থাকতে হয় রিজভীকে। তারা ভবনে তালা মেরে দেওয়ায় চিকিৎসকও ভেতরে যেতে পারেননি।
শারীরিক অবস্থার খবর জানতে চাইলে রিজভী রাতে আক্ষেপের সুরে বলেন, “আমি খুব কষ্টে আছি। আমি খুব অসুস্থ। উঠেও দাঁড়াতে পারছি না।
“বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা আমাকে দেখতে আসতে পারছেন না। কারণ আমার ছোট ভাইদের কারণে অফিসে তারা ঢুকতে পারছেন না। এখানে থেকে টেলিফোনে ডাক্তারের সাথে কথা বলে সব কিছু করা হচ্ছে।”
ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রিজভী বর্তমানে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিবের পদে রয়েছেন। দলের দপ্তর তিনিই দেখভাল করেন। তৃতীয় তলায় দপ্তর বিভাগের পাশে ছোট একটি কক্ষে তিনি থাকেন।
সোমবার বেশ কয়েকবার বমি হওয়ার পর দলের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে কার্যালয়েই তার চিকিৎসা চলছে। তাকে দেওয়া হচ্ছে স্যালাইন।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে এবার ঈদও নয়া পল্টনের এই কার্যালয়ে কাটিয়ে আসা রিজভীর স্বাক্ষরেই গত ৩ জুন ছাত্রদলের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি আসে।
বিএনপির ওই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ছাত্রদলের নেতারা দুপুরে নয়া পল্টনের কার্যালয়ের সামনে গণ্ডগোল শুরু করেন।
কার্যালয়ের প্রধান ফটকে বিক্ষোভের পর তারা ঝুলিয়ে দেন। তারা বের করে দেন কার্যালয়ের কর্মচারীদের। সাড়ে ১২টার দিকে তারা বিদ্যুৎ সংযোগও বন্ধ করে দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সেখানে উপস্থিত হওয়ার পর ঘণ্টাখানেকের জন্য বিদ্যুৎ ফিরে পেয়েছিলেন কার্যালয়ে থাকা রিজভীসহ অন্য কয়েকজন।
এসব ‘পোলাপানের মান-অভিমান’ বলে মির্জা আব্বাস বেরিয়ে যাওয়ার পর আবারও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্রদল নেতারা। সন্ধ্যায় মাগরেবের নামাজের সময়ে বিদ্যুৎ আবার ফেরত আসে।
বিএনপির সহ স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দলীয় নেতা রিজভীর দেখভাল করছেন। গত রাতে থেকে ভোরে তিনি নিজের বাসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রদল নেতাদের বিক্ষোভ-অবরোধের কারণে সারা দিনে আর ঢুকতে পারেননি। বিক্ষোভ স্তিমিত হলে রাত ৮টা পর তিনি রিজভীর কাছে যান।
রাত ৯টার দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তালা খুলে দেন ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতারা। এরপর কয়েকজন তৃতীয় তলায় উঠে অসুস্থ রিজভীকে দূরে থেকে দেখেও আসেন।
বিএনপি কার্যালয়ে থাকা কর্মচারীরা জানান, রিজভী তার ওই কক্ষে বিছানায় শুয়ে আছেন। তার ডান হাতে স্যালাইন লাগানো হয়েছে। তিনি খেতে পারছেন না, তার ঘুমও হচ্ছে না।
মোবাইল ফোনে কল করা হলে নিজেই তা ধরেন রিজভী।
তিনি বলেন, “আমার কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে। আমি অসুস্থ। মুখে খেতে পারছি না। বমি হচ্ছে। এখন স্যালাইনে সব কিছু হচ্ছে।”
রিজভীর সেবা শুশ্রুষা করছেন তার একান্ত কর্মী আরিফুর রহমান তুষার। স্ত্রী আনজুমান আরা সোমবার রিজভীর পাশে ছিলেন।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর দলে সংস্কারের ঢেউয়ের মধ্যেও দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি আনুগত্য ধরে রেখে সক্রিয় ছিলেন বিএনপির তখনকার সহ দপ্তর সম্পাদক রিজভী।
তখন থেকেই দপ্তর সামলে আসছেন তিনি। আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে যুগ্ম মহাসচিবের পর এখন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন তিনি।
গত ১০ বছরের অধিকাংশ সময়ই কার্যালয়ে থেকে সংবাদ সম্মেলন করে দলের বক্তব্য-বিবৃতি নিয়মিত প্রচার করে আসছেন রিজভী। একবার পুলিশ তাকে কার্যালয়ের ভেতর থেকে তুলেও নিয়ে গিয়েছিল।
গত বছরের জানুয়ারি মাস থেকে দ্বিতীয় দফায় রিজভী এক টানা নয়া পল্টনের এই কার্যালয়ে রয়েছেন।
এবার ঈদও তিনি করেছেন দলের কার্যালয়েই। ঈদের দিন স্ত্রী আনজুমান খাবার রান্না করে স্বামীর জন্য নিয়ে এসেছিলেন। এমনিতেই প্রতি সপ্তাহে এক-দুইদিন বাসা থেকে খাবার আসে তার জন্য।
রিজভীকে কেন দলীয় কার্যালয়ে থাকতে হয়- এই প্রশ্ন করা হলে তার ঘনিষ্ঠ বিএনপি নেতারা জানান, এটা দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই হচ্ছে। এক বছর আগে ব্যাপকহারে নেতাদের গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কার্যালয়ে থাকতে বলা হয়।
রিজভী বলেন, “যা কিছুই এখানে থেকে করতে হচ্ছে, তা দলের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশে হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত কোনো কিছু এখানে নেই। সিনিয়র নেতারা যেসব সিদ্ধান্ত নেন, সেটা যদি সিদ্ধান্ত হয়, নির্দেশ পেলেই আমি তা আপনাদের বলি।”
বিক্ষুব্ধ ছাত্রদল নেতারা কমিটি ভাঙার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহারের দাবি জানানোর পাশাপাশি বিজ্ঞপ্তি স্বাক্ষরকারী রিজভীকে বিদ্রুপ করে নানা স্লোগানও দেন দিনভর।
এ বিষয়ে রিজভী বলেন, “আমি দলের নেতার নির্দেশে কাজ করি। এখানে আমার কী করার আছে? দলের সর্বোচ্চ লেভেলে যেসব সিদ্ধান্ত হয়, যা জানাতে বলা হয়, আমি আদেশ মান্য করি। এখানে আমার আর কিছু বলার নেই।”
ছাত্রদলের নেতাদের বিক্ষোভ চলার সময়ই কার্যালয়ের বাইরে একটি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে ছিল। গয়েশ্বর রায় বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, রিজভীকে হাসপাতালে নেওয়া হবে কি না?
গয়েশ্বর বলেন, “এটা চিকিৎসকরা ঠিক করবেন। কিন্তু কোনো পরিস্থিতি বা এই ঘটনার জন্য তাকে বাইরে যেতে হবে- এটা যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন না।”
ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রিজভী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) ভিপি ছিলেন। তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। সেই ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। চলাচলেও তাকে লাঠি ব্যবহার করতে হয়।
এখনকার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, “বুঝতেই পারছেন আমি কথা বলার মতো শক্তি পাচ্ছি না। গতকাল থেকে খাবার পেটে থাকে না। স্যালাইনের এই তরল খাবারে তো শক্তি আসে না, প্রাণের স্পন্দনটা শুধু সচল থাকে মাত্র।”