ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারের ওপর স্থিতাবস্থার মেয়াদ আরও দুই মাস বাড়িয়েছে হাই কোর্ট।
বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এক রিট মামলার শুনানিতে এ আদেশ দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়ে যে সার্কুলার জারি করেছিল, হাই কোর্টের এই আদেশের ফলে আগামী ২৪ অগাস্ট পর্যন্ত তার কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।
আর্থিক খাতের দুর্নীতি বন্ধের বিষয়ে হাই কোর্ট এর আগে যে রুল জারি করেছিল, দুই সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা আকারে তার জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিবাদীদের।
আর ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-বিএবি এ মামলায় পক্ষভুক্ত হতে পারবে কিনা তাদের সে আবেদনের ওপর আগামী রোববার শুনানির দিন রেখেছে আদালত।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ এই রিট আবেদন করার পর গত ৩০ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণ খেলাপিদের তালিকা চেয়েছিল।
গত ২০ বছরে কোটি টাকার উপরে ঋণ খেলাপিদের তালিকা, কী পরিমাণ ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়েছে, ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম চলছে, তা বন্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেসব তথ্য ২৪ জুনের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংককে।
সে অনুযায়ী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী হিসেবে আদালতে সিলগালা অবস্থায় ওই প্রতিবেদন জমা দেন।
তার সাথে একটি বাস্তবায়ন প্রতিবেদনও দেন মাহবুবে আলম। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মুনিরুজ্জামান।
রিটকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে শিুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আর মাহমুদ বাশার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আদালতে জানানো হয়, এ পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণসহ মোট ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণের হিসাব দেওয়া হয়েছে বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে।
এর মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকা এনপিআর (নন পারফর্মিং লোনস) হিসেবে দেখিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন মামলার কারণে ওই টাকা আটকে আছে। ফলে এটাকে খেলাপি ঋণ বলা যাবে না। অবলোপিত ঋণের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আদেশের পর সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২০ বছরের ঋণ খেলাপিদের তালিকা সিলগালা অবস্থায় আদালতে দিয়েছে।
“বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে তারা বলেছে, বাংলাদেশের আইনে ঋণ খেলাপিদের তথ্য প্রকাশ করার কোনো বিধান নাই। কিন্তু আদালতের নির্দেশের কারণে এটা দাখিল করতে হয়েছে।”
মনজিল মোরসেদ বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পক্ষে শুনানি করতে চাইলে তারা আপত্তি জানিয়েছেন।
“যেহেতু এখানে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি পক্ষ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। ফলে মামলায় কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হলে মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানিতে অংশ নিতে পারবেন না। আদালত তখন আমাদের শুনানি গ্রহণ করে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তার বক্তব্য শুনেছেন।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী মুনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, তারা যে প্রতিবেদন আদালতে দিয়েছেন, সেখানে ১০ হাজার ৪৭৬টি অ্যাকাউন্টের খেলাপি ঋণের তথ্য দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর টাকার অংক কোটির উপরে।
এসব অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট আছে ১ হাজার ১০৬টি, বাকি ৯ হাজার ৩৭০টি অ্যাকাউন্ট ব্যাংকের।
মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত জানতে চাইলে এ আইনজীবী বলেন, “মোট কত টাকার খেলাপি ঋণ এখন আছে সে তথ্য এ প্রতিবেদনে নেই। কারণ কোর্টের আদেশ ছিল কোটি টাকার ওপরে যারা খেলাপি, তাদের নাম-ঠিকানা দিতে হবে।… নাম-ঠিকানার ভিত্তিতেই এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, সেখানে কোনো ক্রমিক নম্বর দেওয়া হয়নি, টাকার অংকও নেই।”
ব্যাংক খাতে অর্থ আত্মসাৎ, ঋণ অনুমোদনে অনিয়ম, সুদ মওকুফ সংক্রান্ত বিষয় তদন্ত ও সুপারিশ প্রণয়নে কমিশন গঠন করতে গত ২৩ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট ৫ সচিবসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে উকিল নোটিস দিয়েছিল হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। তাতে সাড়া না পেয়েই এ রিট আবেদন করেন মনজিল মোরসেদ।
এরপর ১৩ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্ট যে আদেশ দেয়, সেখানেই ঋণ খেলাপিদের তালিকা, সুদ মওকুফের তথ্য এবং অর্থপাচারের পরিমাণ নিয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয় বাংলাদেশের ব্যাংকের কাছে।
পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে আর্থিক দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে আদালত।
আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, সালেহ উদ্দিন আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, সিটি ব্যাংক এন এ বাংলাদেশের সাবেক সিইও মামুন রশিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধিকে নিয়ে একটি কমিশন গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এবং সেই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে।
চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুই সচিব, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
রোববার আদালত ওই রুলের জবাবই হলফনামা আকারে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে দাখিল করতে বলেছে বিবাদীদের।
এদিকে এ রিট মামলা চলার মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়ে সার্কুলার জারি করে।
পরে রিটকারী পক্ষের আবেদনে গত ২১ মে হাই কোর্ট ওই সার্কুলারের উপর ২৪ জুন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা দেয়, যা রোববার আরও দুই মাস বাড়ানো হল।