বন্যার পানিতে ডুবে গতকাল ছয় শিশু মারা গেছে। কুড়িগ্রামের চিলমারি ও উলিপুরে দুই জন আর জামালপুরে তিন শিশু ও এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে, টানা কয়েক দিনের বৃষ্টি ও ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে উঁচু বাঁধের ওপরে খোলা আকাশের নিচে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির অপ্রতুলতা, গবাদিপশুর নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে। সরকারি ত্রাণ স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কিছু কিছু এলাকায় পৌঁছানোর খবর পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ দুর্গত এলাকাতেই পৌঁছায়নি ত্রাণসামগ্রী। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী না পাওয়ায় মানুষের মাঝে হাহাকার দেখা দিয়েছে। আমাদের আঞ্চলিক অফিস, জেলা প্রতিনিধি ও থানা সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ছয় শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু
কুড়িগ্রামের চিলমারি উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের গাবেরতল এলাকার মো. বাদশা মিয়ার ১০ বছরের মেয়ে বাড়ির উঠানে পানিতে ডুবে মারা গেছে। এ জেলার উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ব্যাপারি গ্রামে হাবিবুল্লাহ নামে ছয় বছরের এক শিশু মারা গেছে। জামালপুর জেলায় ভয়াবহ বন্যার পানিতে ডুবে গতকাল দেওয়ানগঞ্জ ও মেলান্দহ উপজেলায় ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ পৌর সভার চর কালিকাপুর এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেনের দুই বছরের ছেলে রিয়ামুল হক, একই এলাকার বাসিন্দা জহুরুল ইসলামের তিন বছরের ছেলে নাঈম এবং উপজেলার ডাংধরা ইউনিয়নের পাথরের চর এলাকার বাসিন্দা বাকির হোসেনের ছেলে সাত বছরের সাইমুল হক বন্যার পানিতে ডুবে তারা মারা গেছে। এদিকে, মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের খসিমারা এলাকার বাসিন্দা শাহ আলমের ছেলে নবম শ্রেণির পড়ুয়া ছাত্র জুনায়েদ আহমেদ মাছ ধরতে গেলে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে যায়। তার খোঁজ মেলেনি। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল অনুসন্ধান চালিয়ে কোনো সন্ধান পায়নি।
দুই-তিন দিনের মধ্যে বাড়বে বৃষ্টি
দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। গতকাল জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে সর্বোচ্চ ১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, দেশের কিছু কিছু স্থানে বৃষ্টিপাতের মাত্রা খানিক কমে এলেও দুই-তিন দিনের মধ্যেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়বে। ফলে, ঢল ও বৃষ্টির কারণে বন্যার মাত্রাও বাড়তে পারে। বিশেষ করে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দুই-তিন দিন পরে আরো বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি বাড়তে পারে
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া জানান, গতকাল দেশের ২৬টি পয়েন্টে দেশের প্রাণ প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জানান, সুরমা কুশিয়ারা ছাড়া দেশের সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানাচ্ছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি বাড়তে পারে। আর কাল সকালের মধ্যে ধলেশ্বরী নদীর পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করতে পারে।
গ্রামের পর গ্রাম নতুন করে প্লাবিত
গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়ে সোমবার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্রের পানির তোড়ে আরো তিনটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে। এতে ৩১টি গ্রামের ফসল পানিতে ডুবে গেছে। ফলে জেলার গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার ২৬টি ইউনিয়নের আড়াই লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলায় তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে দেড় হাজার হেক্টর জমির ফসল। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি, নাগেশ্বরী, চিলমারি ও উলিপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, বাড়িঘর। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জেও বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও নদীর পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ধসে পড়েছে নাটুয়ারপাড়া নদীরক্ষা বাঁধ। গতকাল বিকাল পর্যন্ত এ বাঁধের ৩০০ মিটার ধসে গেছে বলে জানা গেছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে ওয়াপদা বাঁধ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে বানভাসি মানুষ।
জামালপুরে ৭টি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৪০ হাজার পরিবারের ২ লাখের বেশি মানুষ। তলিয়ে গেছে ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীতে বন্যায় ৪০ গ্রামের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। বন্ধ হয়ে গেছে ৩৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, বারহাট্টা, পূর্বধলা ও কলমাকান্দার ২০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।
৭ দিনেও চালু হয়নি বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ
বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে প্রধান সড়ক বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় সাত দিনেও চালু হয়নি বান্দরবানের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ। বৃষ্টি বন্ধ হলেও সাঙ্গু নদীর পানি এখনো বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি নামতে শুরু করায় আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে ঘরে ফিরছে দুর্গতরা। এদিকে, বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিসহ পানিবাহিত নানা ধরনের রোগ ছড়ানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের ৪১টি মেডিক্যাল টিম কাজ শুরু করেছে।
সিলেট অফিস থেকে স্টাফ রিপোর্টার হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী জানান, পাহাড়ি ঢল অব্যাহত রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলছে। সিলেটের সাতটি ও সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার ৫ লাখ লোক পানিবন্দি। ডুবে গেছে ৫ হাজার ৫৮৭ হেক্টর জমির ফসল।
এদিকে, পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলা প্লাবিত হয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তলিয়ে গেছে সব উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক।