দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নদনদীর পানি দুই সপ্তাহ ধরে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গাইবান্ধায় বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যমুনার পানিতে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জামালপুরের ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৯টিই বন্যাকবলিত। পানিবন্দি চার লাখেরও বেশি মানুষ। রেললাইনে পানি ওঠায় বন্ধ জামালপুর-সরিষাবাড়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত ট্রেন চলাচল। পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বাড়ায় শেরপুরে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ।
কুড়িগ্রামে নদনদীর পানি দেড় সপ্তাহ ধরে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে। সরকারি তথ্যমতেই জেলার ৯ উপজেলার ৭৩ ইউনিয়নের মধ্যে ৫৬ ইউনিয়নের ৪৯৮টি গ্রামের সোয়া ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। চলছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। এদিকে বুধ ও বৃহস্পতিবার গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের উলিপুরে পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
উলিপুর (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, উলিপুরে পানিতে ডুবে বাবুল মিয়ার মেয়ে ববিতা খাতুন (১৬) ও সুজন মিয়ার দেড় বছরের ছেলে মারা গেছে। বুধ ও বৃহস্পতিবার এসব ঘটনা ঘটে।
গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের ২৩০টি গ্রামের তিন লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রেললাইন পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বাদিয়াখালী থেকে ত্রিমোহনী রুটে দ্বিতীয় দিনের মতো ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গত দু’দিনে সদর উপজেলার খোলহাটী ইউপির গোদারহাটে পানিতে ডুবে শিশু সোহাগ ও সাঘাটার উজ্জ্বল কুমার (১৫) সাপের দংশনে মারা গেছে।
জামালপুরে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি উপচে প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন জনপদ। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এ জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। এতে জেলার মাদারগঞ্জ, ইসলামপুর, বকশীগঞ্জ, ওয়ানগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও মেলান্দহ উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। বন্যার পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত পাঁচ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। জামালপুরের মাদারগঞ্জে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ৩০ গ্রাম।
যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় বিপদসীমার ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। কাজীপুরের মেঘাইয়ে রিং বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পাঁচটি গ্রামের শত শত পরিবার নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে কাজীপুর-ধুনট সড়কে যান চলাচল।
বগুড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানি বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। তিন উপজেলায় ১০২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলায় বন্ধ রয়েছে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সবজি, পাট, বীজতলা, আউশসহ প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে।
এদিকে লালমনিরহাট, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে পানি কমছে। চট্টগ্রামের পাহাড়ি জেলা ও কক্সবাজারে আকস্মিক বন্যা ও পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বোর্ডের ৯৩টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে ৪৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমায় পৌঁছে যাচ্ছে। আর ৪৪টি পয়েন্টে পানি কমছে। ২৫টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। অপরিবর্তিত আছে একটি পয়েন্টে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকায় আগামী ২৪ ঘণ্টা পানি বাড়বে। শীতলক্ষ্যা নদীর পানি শুক্রবার বিপদসীমা অতিক্রম করবে। তবে দেশের উজানে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এ সপ্তাহে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
ত্রাণ নিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে ব্র্যাক: সরকারের পাশাপাশি বন্যাকবলিত মানুষের সহযোগিতায় পাশে দাঁড়িয়েছে ব্র্যাক। এরই মধ্যে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা ইউনিয়নে দুটি টিউবওয়েল ও দুটি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন করেছে। দেশের অন্যান্য বন্যার্ত এলাকায় আরও স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন, টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ চলছে। শুকনো খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিতরণ করা হচ্ছে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি।