ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে আড়াই মাস আগে ঢাকার সিটি করপোরেশনের দুই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে সতর্ক করা হলেও তারা ‘গা না করায়’ অসন্তোষ প্রকাশ করেছে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ।
বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চে বুধবার একটি রিট মামলার শুনানিতে ডেঙ্গুর প্রসঙ্গটি আসে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ ও ভয়াবহতার বিষয়ে সতর্ক করে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ে আমরা আনেক আগেই সতর্ক করেছিলাম। দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ডেকে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া রোধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম।
“কিন্তু তারা গা করেননি। দুই-তিনজন মারা যাওয়ার পর ভাসা ভাসা কথা বললেন। অথচ তিনটি জেলা ছাড়া সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এখন লাস্ট স্টেজে এসে নড়ে চড়ে বসলেন।”
বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক এ সময় বলেন, “প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেছেন। তাকে সেখান থেকে নির্দেশনা দিতে হচ্ছে। সরকারি কর্মচারীরা কী করছেন! তাদের বেতন-ভাতা, গাড়ি সবই তো জনগণের করের টাকায়।
“কিন্তু জনগণ সেবা পাচ্ছে না। কথা বললে তো বলবেন বেশি বলছি… প্রশাসন যেখানে ব্যর্থ হচ্ছে জুডিশিয়ারি সেখানে হস্তক্ষেপ করছে।”
ঢাকায় এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুজ্বরে প্রকোপ বাড়তে শুরু করে গত জুন মাস থেকে। জুলাইয়ের শেষে এসে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের প্রায় সব জেলায়ভ
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের্ মেয়র সাঈদ খোকন পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ আছে বলেই দাবি করে আসছিলেন। ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ে ‘ছেলেধরার মত গুজব’ ছড়ানো হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
তবে রোববার ঢাকার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীদের দেখতে গিয়ে তিনিও স্বীকার করেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন ‘উদ্বেগজনক’।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ১৮৩ জন, যাদের ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে সংবাদপত্রে আসা খবরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা এ বছর অর্ধশত ছাড়িয়েছে।
এডিস মশার প্রজননস্থানগুলো ধ্বংসে সফলতা না এলে এ রোগের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রাজধানীর ‘ধুলোবালি প্রবণ’ এলাকাগুলোতে দিনে দুইবার পানি ছিটাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কী ব্যবস্থা নিয়েছে, আদৌ পানি ছিটানো হয় কিনা সে বিষয়ে জানতে গত ৫ মে ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে তলব করেছিল হাই কোর্ট।
পরে ১৫ মে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান আদালতে হাজির হলে রাজধানী ঢাকার রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধাতা, ধুলোবালি, উন্নয়নকাজ, মশা নিধনসহ বেশ কিছু বিষয় শুনানিতে উঠে আসে।
সেদিন বেঞ্চের জেষ্ঠ বিচারক এফ আর এম নাজমুল আহাসান সিটি করপোরেশনের দুই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “যদিও রুলের টার্মে এটা নেই, তারপরও বলছি পাবলিক ইন্টারেস্টের বিষয়। এই যে বর্ষার সিজন আসছে, আপনারা যদি এখনই স্টেপ না নেন তাহলে কিন্তু ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ায় মানুষ আক্রান্ত হবে।
“আমরাও কিন্তু ভুক্তভোগী, হাসপাতালে থাকতে হয়েছে গত বছর। এ বিষয়গুলো আপনারা ভালভাবে দেখবেন। আগে থেকেই পদক্ষেপ নেবেন। ২০ তলার উপরেও মশা। এখন থেকেই যদি শুরু না করেন এই সিজনে আরও বাড়বে কিন্তু।”
বিচারক সেদিন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, “এগুলো দেখবেন, কারণ, এখানে বিদেশি দূতাবাস আছে। মশার বিষয়টি দেখবেন। আর আপনারা তো বিদেশে যান ঘন ঘন। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর তো সমুদ্রের মধ্যে দ্বীপ। তারা কত ডিসিপ্লিনড, রাস্তাঘাট কত পরিষ্কার।
“আমাদের রাজধানী শহর, এখানে বিদেশিরা আসে, দেখে। যতটুকু দায়িত্ব আছে, বাজেট আছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার। সাবেক মেয়র আনিসুল হক কিছু ভাল উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আশা করি বর্তমান মেয়র সেগুলো এগিয়ে ।”
শুনানি শেষে এ আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত বলেছে, আমাদের দেশে কোনো কিছুই প্রথম থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয় না। যখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে তখন সবাই নড়েচড়ে বসে।”
রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, “প্রশাসনের এই যে ব্যর্থতা ও দুর্বলতা, এতে আদালত অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন। ভয়াবহ রূপ ধারণ করার আগে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।”