বৃস্পতিবার রাত ১১টায় ঢাকার শ্যামলী থেকে ‘এনা পরিবহনের’ বাসে কুড়িগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করেন সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক সরকার। ৩৪০ কিলোমিটার দূরের এ গন্তব্য সড়কপথে যেতে সর্বোচ্চ ৯ ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ শুক্রবার রাত ৮টায় তিনি ছিলেন রংপুরে। ২১ ঘণ্টায় যেতে পেরেছেন ৩০০ কিলোমিটার। ঘণ্টায় গতিবেগ ১৪ কিলোমিটার!
আবদুর রাজ্জাক সরকারের মতো ঈদযাত্রায় ঘরমুখো লাখো মানুষ উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে যমুনার দুই পাড়ে ৬০ কিলোমিটার যানজটের মহাদুর্ভোগে পড়েন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে কাটান। ঢাকা থেকে উত্তরের জেলা পঞ্চগড় যেতে ৩০ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগছে। যদিও শুক্রবার গাবতলী টার্মিনাল পরিদর্শনে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়কে সমস্যা হচ্ছে না। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ফেরিঘাটে নদী পারাপারে বিলম্বে যানজট হচ্ছে। ভারি বৃষ্টি না হলে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে করেন মন্ত্রী।
শুধু সড়কে নয়, দুর্ভোগে ছিলেন ট্রেনের যাত্রীরাও। পশ্চিমাঞ্চলের সবক’টি ট্রেন ঢাকা থেকে তিন থেকে সাত ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে যায়। টাঙ্গাইলে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। এতে দুর্ভোগ আরও বাড়ে। চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ ও জামালপুরগামী ট্রেন কম-বেশি আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে।
ঢাকা-ময়মনসিংহের টঙ্গী-গাজীপুর অংশে দিনভর যানজট ছিল। ঢাকা থেকে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬ জেলার যাত্রীরা চরম দুর্ভোগ পোহান আরিচা এবং মাওয়া ঘাটে। ঢাকা থেকে ঘাট পর্যন্ত মহাসড়কে ছিল তীব্র যানজট। ফেরি পারাপারের জন্য ঘাটে ছিল যানবাহনের দীর্ঘ সারি। চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে পদ্মা পাড়ি দিতে। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যাত্রীরা ছিলেন স্বস্তিতে। এই দুই মহাসড়কে যানজটের খবর পাওয়া যায়নি।
ফেরি পারাপারের মতো দুর্ভোগ ছিল সেতুতেও। সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল দিতে ঘণ্টা খানেক লাইনে পড়তে হয় উত্তরবঙ্গের যাত্রীদের। যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সেতু কর্তৃপক্ষ টোল আদায় বন্ধ করে দেয়।
আগামী সোমবার পবিত্র ঈদুল আজহা। বৃহস্পতিবার ছিল ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস। বৃহস্পতিবার অফিস শেষে যাত্রীর ঢল নামে বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশনে। শুক্রবার এ ভিড় আরও বাড়ে। রাজধানীর গাবতলী, শ্যামলী, কল্যাণপুরের বাস কাউন্টারগুলোতে ছিল লাখো যাত্রীর ভিড়। অভিন্ন অবস্থা ছিল মহাখালী, সায়েদাবাদ টার্মিনালে।
যাত্রীর ভিড়ের সুযোগ নিয়ে শেষ সময়ে বাসগুলো ভাড়া নিয়েছে ইচ্ছামাফিক। গাবতলী থেকে আরিচাঘাট পর্যন্ত ৮০ টাকার ভাড়া নেওয়া হয় ৪০০ টাকা। নন-এসি লোকাল বাসে রংপুরের ভাড়া নেওয়া হয় হাজার টাকা। অথচ সাধারণ সময়ে এসব বাসে ভাড়া ৩০০ টাকা। মহাখালী থেকে ময়মনসিংহের ভাড়া ২০০ টাকা হলেও নেওয়া হয় ৬০০ টাকা। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বাড়তি ভাড়া রোধে মনিটরিং হচ্ছে। কোনোভাবেই বাড়তি ভাড়া সহ্য করা হবে না।
যানজটের কারণে যাত্রীরা শুধু মহাসড়কে নয়, ভুগছেন ঢাকাতেও। মহাখালীতে এনা পরিবহনের রংপুরের কাউন্টারে কথা হয় ইসমত কাদেরের সঙ্গে। তিনি জানান, সকাল ৭টায় তার বাস ছাড়ার কথা। দুপুর ১২টার সময়ও বাসের খবর নেই। কাউন্টার থেকে জানানো হয়েছে, এলেঙ্গায় যানজটে রয়েছে।
এনা পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক আবদুল কাদের জানান, বৃহস্পতিবার সকালে যে বাস ঢাকা থেকে ছেড়ে রংপুর গিয়েছিল, তা শুক্রবার দুপুরেও ঢাকায় ফিরতে পারেনি যানজটের কারণে। তাই ঢাকা থেকে নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়া যাচ্ছে না। কয়েকটি ক্ষেত্রে বিকল্প বাস দেওয়া হয়েছে।
ঘরে ফেরা মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে উত্তরবঙ্গগামী সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক সরকারের জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে শ্যামলী ছাড়ার পর রাত ২টার দিকে চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহাসড়কে আটকা পড়েন। এক জায়গায় আটকে থাকেন ৯ ঘণ্টা। পরে টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর আটকে থাকেন এক ঘণ্টা। সেতু পার হওয়ার পর সিরাজগঞ্জে নলকা সেতুর আগে আবার তিন ঘণ্টা আটকে থাকেন। তিনি বলেন, বাসে নারী-শিশু-বয়স্ক যাত্রী রয়েছেন। ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।
সাভার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত গাড়ির তীব্র চাপ ছিল ঢাকা-আরিচা, নবীনগর-চন্দ্রা এবং বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর মহাসড়কে। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট ছিল দুই মহাসড়কে।
কালিয়াকৈর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চন্দ্রার ত্রিমোহনীতে ফ্লাইওভার উদ্বোধনের পর ঈদুল ফিতরের সময় যানজট ছিল না। এবার চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহাসড়কে তীব্র যানজট। গার্মেন্ট ছুটির পর বৃহস্পতিবার থেকেই যাত্রীর ঢল নেমেছে সড়কে। ওই দিন বিকেলে শুরু হওয়া যানজট গতকালও কাটেনি।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে শুরু হওয়া যানজট গতকাল ভোরে কেটে যায়। তবে সকাল থেকে ফের যানজট শুরু হয়। হাইওয়ে পুলিশের বগুড়া সার্কেলের অতিরিক্ত সুপার মো. শহিদুল্লাহ বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্তে নলকা ও ইছামতি সেতু দুই লেনের ও পুরনো। এ কারণে যানজট হচ্ছে।
রেলস্টেশনে যাত্রীর ঢল : বৃষ্টি-বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে দুর্ভোগের ভয়ে এবার ট্রেনে যাত্রীর চাপ বেশি। শুক্রবার উপচেপড়া ভিড় ছিল কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনে। তাদের দুর্ভোগ বাড়ায় ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়। রাজশাহীগামী সিল্ক্কসিটি ও পদ্মা এক্সপ্রেস দেরি করে ছয় ঘণ্টা। চার ঘণ্টা দেরি করে রংপুর এক্সপ্রেস। সকাল ৬টার রাজশাহীগামী ‘ধূমকেতু এক্সপ্রেস’ ঢাকা থেকে ছেড়ে যায় ১১টায়।
খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে তিন ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে গিয়ে টাঙ্গাইলে লাইনচ্যুত হয়। এ কারণে আড়াই ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত পশ্চিমাঞ্চলের সব ট্রেন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে এ দুর্ঘটনার কারণে।
কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রতিটি ট্রেন যাত্রীতে কানায় কানায় পূর্ণ। বাড়তি যাত্রীর কারণে ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চলছে না। এ কারণে ট্রেন যেতে বিলম্ব করছে। ঢাকায় ফিরতেও দেরি করছে।
ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা চিলাহাটিগামী ‘নীল এক্সপ্রেস’-এর যাত্রী কুদরত-ই-খোদা বলেন, সকাল ৯টার ট্রেন ১টার সময় ছাড়বে। এ কেমন কথা! খালি আশ্বাস দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে আর বিলম্ব হবে না। কিন্তু প্রতি ঈদেই একই অবস্থা। তারপর স্টেশনে পরিবার নিয়ে অপেক্ষার একটু ভালো জায়গা নেই। মানুষ যাবে কোথায়?
সন্ধ্যায় বিমানবন্দর স্টেশন পরিদর্শন করেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। ঈদযাত্রায় ট্রেনের ছাদে না উঠতে যাত্রীদের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন রেল পুলিশের কর্মকর্তারা। তবে গতকাল মন্ত্রীর সামনেই ছাদে ওঠেন যাত্রীরা। তিনি হাত নেড়ে ঈদের শুভেচ্ছাও জানান।
সরেজমিন দেখা যায়, ট্রেনের ছাদ, ইঞ্জিন, খাবার বগি কোথাও তিল পরিমাণ জায়গা নেই। যে যেখানে জায়গা পেয়েছেন, বসে গেছেন আনন্দের ঈদযাত্রায়।