জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তঋণ পরিশোধে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণসভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগের দু’দিনব্যাপী কর্মসূচির শেষ দিনে ছিল এই স্মরণসভা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা শেষ কথা বলেছিলেন– প্রয়োজনে বুকের রক্ত দেবেন। আর সেই রক্তই তিনি দিয়ে গেছেন। আমাদের সেই রক্তঋণ শোধ করতে হবে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে।’
তিনি বলেন, পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িতদের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের যোগাযোগ ছিল। তারা জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে ইশারা পেয়েছিলেন। খুনিদের এমন মনোভাব ছিল যে, তাদের কিছুই হবে না।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের দিনে সেই প্রতিজ্ঞাই আমরা করি যে, পিতা তোমাকে কথা দিলাম– তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশই আমরা গড়ে তুলব। এটাই আমাদের অঙ্গীকার।’
বক্তব্যের শুরুতে জাতির পিতার নেতৃত্বে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে তার সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠন যে দুরূহ কাজ, এটা যে একদিনে হয় না– এটা যদি সবাই উপলব্ধি করতে পারতেন, তাহলে হয়তো-বা ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটত না। তবে আমাদের দেশের জ্ঞানী-গুণী ও অনেক রাজনীতিবিদই তখন এটা উপলব্ধিই করতে পারেননি। এটা হলো না, ওটা হলো না– তা নিয়ে কত আক্ষেপ আর কত লেখালেখি!’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জাতির পিতার সময় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সাত ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছিল। চালের দাম ১০ টাকা থেকে তিন টাকায় নেমে এসেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যখন ব্যাহত করা যাচ্ছিল না, তখনই ষড়যন্ত্র করে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আরও আগেই দেশ উন্নত হতো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যায় দেশি-বিদেশি অপশক্তি এবং পাকিস্তানের পরাজয়ে ব্যথিত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্র ছিল। এই হত্যাকাণ্ডকে একটি পারিবারিক হত্যাকাণ্ড হিসেবেই দেখাতে চেয়েছিল খুনিচক্র। কিন্তু ধীরে ধীরে এটাই পরিষ্কার হয়েছে– এই হত্যার উদ্দেশ্য ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়া।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা কিন্তু অপরিচিত নন। যারা আমাদের বাড়িতে আসতেন, তারাই পরে হত্যাকারী হিসেবে আবির্ভূত হন। জিয়াউর রহমান প্রতিমাসে একবার করে আসতেন। সঙ্গে খালেদা জিয়াকেও নিয়ে আসতেন, যাতে আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করা যায়। মেজর ডালিম, কর্নেল হুদা– এরাও আসতেন। এরাই পরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড চালালেন। আর মোস্তাক তো মন্ত্রীই ছিলেন। পরে দেখা গেছে খুনিদের সহযোগীদের অনেকেই বিএনপিতে যোগ দিয়ে বড় বড় কথা বলছেন, নীতির কথা বলছেন। তারাও কি ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন না? তারা ভেবেছিলেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন, কিন্তু পারেননি।’
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। এরপর ক্ষমতায় এলেন জিয়াউর রহমান। তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় এলেন। বন্দুকের নলের জোরে বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করে রাষ্ট্রপতি হয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি।
তিনি বলেন, বহু বছর পর উচ্চআদালত রায় দিয়েছেন সংবিধান লঙ্ঘন করে যারা ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাদের সবার শাসনই অবৈধ। এই রায় জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জন্যও প্রযোজ্য। অর্থাৎ জিয়া ও এরশাদের শাসনামল ছিল অবৈধ। হাইকোর্ট রায় দিয়ে তাদের শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সুতরাং তাদের আর রাষ্ট্রপতি বলা যায় না। তারা হলেন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিয়োগান্ত ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে বারবার আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেকে দুর্ভাগা বলেই মনে করি। মাত্র ১৫ দিন আগে বিদেশে চলে গিয়েছিলাম বলে আমি আর আমার ছোট বোন রেহানা বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই বাঁচা বাঁচা নয়। এই বাঁচাটা মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ছয় বছর দেশে আসতে পারিনি, রিফিউজির মতো অন্য দেশে বসবাস করতে হয়েছে। তার পরও আওয়ামী লীগ ও এদেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই যে, তারাই ভালোবেসে আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ অন্তত এটুকু বলতে পারি, জাতির পিতার আদর্শ নিয়েই আমরা চলেছি। কৃতজ্ঞতা জানাই দেশবাসীর প্রতি। বাবা-মা, ভাই- সব এক দিনে হারিয়ে নিঃস্ব-রিক্ত হয়েছিলাম। দেশ ছেড়ে যখন যাই সবই ছিল, যখন ফিরে আসি শূন্য। কেউ নেই। সব হারিয়ে কিন্তু পেয়েছিলাম দেশের লাখো মানুষ। তাদের আপন করে নিয়েছি। আর আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী ও মুজিব আদর্শের সৈনিক, তারাই আমাকে আপন করে নিয়েছেন। সেখানেই পেয়েছি বাবা-মা ভাইয়ের ভালোবাসা, এখানেই আমার সব থেকে বড় শক্তি। সেখান থেকেই আমার বড় প্রেরণা।’
তিনি বলেন, ‘একটি জিনিসই চিন্তায় রেখেছি। আমার বাবা এদেশ স্ব্বাধীন করেছেন। এদেশকে গড়ে তুলতে হবে, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করে তাদের মানুষের মতো বাঁচার সুযোগ করে দিতে হবে। উন্নত জীবন দিতে হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে আজ বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বে একটি মর্যাদার আসনে নিয়ে এসেছি।’
২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, বাংলাদেশ কখনও উন্নত হোক, এদেশের মানুষের অগ্রগতি হোক– খুনির দল সেটা চায়নি। তাদের চাওয়াটাই ছিল পাকিস্তানিরা এদেশের চেয়ে ভালো থাকবে। আর বাংলাদেশ যেহেতু পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছে, তাই বাংলাদেশ যেন পাকিস্তানের চেয়ে উন্নত হতে না পারে। যেন তারা বলতে পারে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ ভুল করেছে, ঠিক করেনি। জিয়াউর রহমানের মতো তার স্ত্রী খালেদা জিয়াও ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছেন, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও মানুষ খুন করেছেন। তারপর তো আরেক দুঃশাসন চলেছে দু’বছর। এই ৭-৮ বছর বাংলাদেশ আরেকটি অন্ধকার যুগে চলে গিয়েছিল।
টানা দুই মেয়াদে দেশের উন্নয়নে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ সারাবিশ্ব বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাত্র ১০টা বছর পরিশ্রম করে আমরা দেশকে উন্নত করেছি, মানুষের উন্নয়ন করেছি, দেশকে বিশ্বে একটি মর্যাদাপূর্ণ আসনে নিয়ে এসেছি। বিশ্বের মানুষ অবাক হয় যে, এত দ্রুত কীভাবে একটি দেশ উন্নত হতে পারে।’
তিনি বলেন, এটা হতে পারে তখনই, যখন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করে এবং নীতি-আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে, তারা ক্ষমতায় থাকে। পরাজিত শক্তির দোসররা ক্ষমতায় থাকলে কোনো দেশ এগোয় না, কোনো জাতি উন্নতও হতে পারে না।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি শুধু এটুকুই বলব যে, শোক-ব্যথা বুকে নিয়েও এদেশের মানুষের জন্য কাজ করেছি। শুধু আমার বাবার কথা চিন্তা করে। তিনি জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন এদেশের জন্য। আজ জাতির পিতা আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার আদর্শ রয়ে গেছে। সেই আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করলে দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস পাবেন। সম্মান পাবেন এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।’
স্মরণসভায় দলের নেতাদের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান, শেখ বজলুর রহমান ও শাহে আলম মুরাদ।
কবিতা আবৃত্তি করেন অধ্যাপক মেরিনা জাহান ও আহকাম উল্লাহ। সভা পরিচালনা করেন ড. হাছান মাহমুদ ও আমিনুল ইসলাম আমিন।