রাসেল ডমিঙ্গোর ট্যাগলাইন আপাতত ‘প্যাশনেট’। কোচ হিসেবে রেকর্ড, অভিজ্ঞতা তো ছিলই, পাশাপাশি তার বাংলাদেশের দায়িত্ব পাওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ প্রবল আগ্রহ। কোচ পদপ্রার্থী হিসেবে সাক্ষাৎকারপর্বে তার বক্তব্য ও উপস্থাপনায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি দারুণ ‘প্যাশন’ ফুটে উঠেছে বলে জানিয়েছেন বিসিবি কর্তারা। কিন্তু সেই কর্তারা যেভাবে পরিচালনা করেন বাংলাদেশের ক্রিকেট, তাতে কতদিন থাকবে ডমিঙ্গোর এই প্যাশন ?
বাংলাদেশে এসে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ডমিঙ্গো নিজেও বলেছেন, ক্রিকেটের প্রতি এই দেশের মানুষের আবেগ দেখে তিনি দায়িত্বটি নিতে উৎসাহী হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের দায়িত্বশীল জায়গাগুলিতে আবেগের যে রূপ মাঝেমধ্যেই দেখা যায়, তাতে ডমিঙ্গোর আবেগ ধাক্কা খেতে পারে বাস্তবতার দেয়ালে।
ডমিঙ্গো দেখেছেন ও জেনেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থক, অনুসারীদের আবেগ। বিসিবি ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের মাঝে নিশ্চয়ই তিনি দেখতে চাইবেন পেশাদারিত্ব, দায়িত্ববোধ। কিন্তু অপেশাদারি নানা নমুনা, অযাচিত বা অতি উৎসাহী হস্তক্ষেপের প্রমাণ হয়তো নতুন কোচ দেখতে পাবেন শিগগিরই।
আনুষ্ঠানিকভাবেই জাতীয় দলের নির্বাচক কমিটির অংশ বাংলাদেশ কোচ। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে জাতীয় দলের নির্বাচক কমিটি দুই স্তরের। কিন্তু বিশাল এই কমিটি থাকার পরও কিন্তু দল নির্বাচনে বড় প্রভাব থাকে এমন একজনের, যিনি কমিটির সদস্য নন – স্বয়ং বিসিবি সভাপতি!
নির্বাচকদের গড়া দলে বিসিবি সভাপতির চূড়ান্ত অনুমোদনের বিতর্কিত একটি ধারা অবশ্য বিসিবির গঠনতন্ত্রে আছে। কিন্তু সেই অনুমোদন মানে নিশ্চয়ই দল নির্বাচনের খুঁটনাটি অনেক কিছুতে হস্তক্ষেপ নয়! ডমিঙ্গো যখন সামনেই এসব দেখবেন, তার প্যাশনে খানিকটা চোট লাগার কথা।
স্কোয়াড নির্বাচন যেমন-তেমন, একাদশ নির্বাচনেও নিয়মিত দেখা যায় বোর্ড সভাপতির হস্তেক্ষেপ। এটি নিয়ে যদিও কোনো ধারা নেই। এরপরও হয়ে আসছে নিয়মিত। তা নিয়ে কোনো লুকোচুরিও নেই। বিসিবি সভাপতি নিজেই অনেকবার বলেছেন, অমুকের জায়গায় তমুককে তিনিই দলে নিয়েছেন। অস্বাভাবিক বিষয়টিই নিয়মিত চর্চায় প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। এ সবকে তিনি হয়তো নিজের দায়িত্বের অংশ বা অধিকার বলেই মনে করেন।
সবশেষ, আগের কোচ স্টিভ রোডসের বিদায়ের প্রসঙ্গেও বিসিবি সভাপতি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি যে একাদশ গড়ে দিয়েছিলেন, সেই দল মাঠে নামাননি কোচ, যেটা বিসিবি সভাপতিকে ভীষণ রুষ্ট করেছিল।
শুধু দল বা একাদশ গড়াই নয়, অনেক সময় রণপরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা করতে হবে বিসিবি সভাপতির সঙ্গে। প্রায়ই টিম মিটিংয়ে উপস্থিত থাকবেন স্বয়ং সভাপতি। উপস্থিত না থাকলে তাকে মাঝেমধ্যে ফোনে জানাতে হবে। ডমিঙ্গোর জন্য নিশ্চয়ই সেটি হবে নতুন অভিজ্ঞতা।
ম্যাচের আগে অনেক সময়ই বিসিবি সভাপতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ্যে বলবেন, কিভাবে খেলা উচিত। অনেক ম্যাচের পর সংবাদমাধ্যমেই বিশ্লেষণ করবেন। ক্রিকেটারদের নাম ধরে প্রকাশ্যে সমালোচনা করবেন। ‘মুশফিক ছক্কা মারতে পারে না’ ধরনের মন্তব্য করবেন, ‘মিরাজ কেন ছক্কা মারতে গেল?’ ধরনের প্রশ্ন করবেন। ডমিঙ্গোর প্যাশন তখন আরও কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশে আসার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সংবাদকর্মীদের ভিড় দেখে ডমিঙ্গো বলেছেন, এত রিপোর্টার আগে কখনই দেখেননি। আসার দিন বিমানবন্দরে শখানেক রিপোর্টার দেখে তিনি রোমাঞ্চিত। কিন্তু যখন দেখবেন, এই সংবাদকর্মীদের এক বড় অংশ ম্যাচের আগে বোর্ড সভাপতির কাছে ‘প্রিভিউ’ পেতে ছুটবেন, ম্যাচ বা সিরিজের পর বোর্ড সভাপতির কাছে জানতে চাইবেন ‘রিভিউ’, বোর্ড সভাপতিও ক্যামেরা-রেকর্ডারের সামনে সানন্দে বিশ্লেষণ করবেন কোন ক্রিকেটার কেমন খেললেন, ডমিঙ্গোর রোমাঞ্চ তখন কমে যাওয়ার কথা।
শুধু এসবই নয়, ক্রিকেটারদের অনুশীলন কখন হওয়া উচিত, টিম মিটিং কখন হবে, জাতীয় দল পরিচালনা থেকে ক্রিকেট অপারেশন্সের দিক, নানা এমনকি জাতীয় দলের পোশাক, সব কিছুতেই যখন ডমিঙ্গো দেখবেন হস্তক্ষেপের নমুনা, তার প্যাশন কতটা থাকবে?
ঘরোয়া ক্রিকেটের খেলা যতটা সম্ভব দেখার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন ডমিঙ্গো। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখবেন নিচের স্তরের লিগগুলোতে আম্পায়ারিং বিতর্ক, দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর।
অবশ্যই পুরো বিসিবির চিত্র এরকম নয়। বোর্ডের অনেক কর্মকর্তাই আছেন, পেশাদারিত্বের সঙ্গে ক্রিকেটের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা দিয়ে দিনের পর দিন কাজ করে চলেছেন। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ে অপেশাদারি আচরণ থাকলে, সেটিই ফুটে ওঠে বেশি স্পষ্ট হয়ে। বাংলাদেশের বাস্তবতায়, ডমিঙ্গোকে কাজ করতে হবে তো শীর্ষ কর্তাদের নিয়েই!
কোচ হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে কখনও কাজ করেননি ডমিঙ্গো। উপমহাদেশের ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকলেও সরাসরি সেটির ছোঁয়া পাননি। বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি ও জাতীয় দল পরিচালনায় যে আবহ পাবেন, নিশ্চিতভাবেই তার জন্য আসবে বড় ধাক্কা হয়ে। অনেক কিছুর সঙ্গেই তাকে আপোস করতে হবে, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। প্রশ্ন হলো, তার এখনকার প্যাশন তখন থাকবে তো?
প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়। আপাতত, এটুকু বলে দেওয়া যায় নিশ্চিত করেই, ডমিঙ্গোর কোচিং ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের দায়িত্ব।