কক্সবাজারে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের গা ঘেঁষে একটি মাঠ। বৃষ্টিতে কাদামাখা সেই মাঠে প্রখর রোদেও জড়ো হন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। মাঠ ছাড়িয়ে সেই সমাবেশ গিয়ে ঠেকে কাছের পাহাড়ে।
ক্যাম্প এলাকার একটি মাঠে সমবেত এই রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালে অগাস্টে মিয়ানমারে নিহত সতীর্থদের স্মরণ করেন। শোকের পাশাপাশি মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিয়ে স্বভূমে ফেরার দাবিতে সংহতির প্রকাশও করেন তারা।
রোববারের সমাবেশ থেকে নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও ভিটেমাটি ফিরিয়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংলাপ আয়োজনের দাবি নতুন করে তোলেন মিয়ানমার থেকে আসা এই শরণার্থীরা।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ সমাবেশে বলেন, “মিয়ানমার মুখে বলল, আর ফিরে গেলাম, তা কোনোভাবে সম্ভব না। আমাদের নিজস্ব অধিকার দিয়ে ফিরিয়ে নিতে হবে।
“এজন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে।”
নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে সর্বশেষ রোহিঙ্গা ঢলের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে এসে কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর বর্ধিত ক্যাম্পের মাঠে ওই সমাবেশ আয়োজন করে সর্বস্তরের রোহিঙ্গারা। তখন বিতাড়িত হয়ে আসা সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা এখন অবস্থান করছে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে।
আগে থেকে বড় জমায়েতের পরিকল্পনার নিয়েছিল সম্প্রতি চার শর্তে মিয়ানমারে ফিরে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশকারী রোহিঙ্গারা। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী সাদা পোশাকের সঙ্গে লুঙ্গি পরে সেখানে যোগ দেওয়ার পরামর্শও ছিল।
সকাল ৯টায় সমাবেশ শুরুর আগে থেকে দলবেঁধে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সমাবেশে হাজির হন রোহিঙ্গারা।
সমাবেশে অনেক রোহিঙ্গা একটি সাদা টি-শার্ট পরে আসেন, যাতে কালো কালিতে লেখা ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর রোহিঙ্গাস।’
ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে রোহিঙ্গা নারীরা সাধারণত ক্যাম্পঘরের বাইরে বের না হলেও ওই সমাবেশে যোগ দেন তাদের অনেকে। ‘রিস্টোর আওয়ার সিটিজেনশিপ’, ‘উইমেন সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি’লেখা নানা পোস্টার ছিল তাদের হাতে।
কুতুপালংয়ে লম্বাশিয়ার ক্যাম্প-১ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সমাবেশে যোগ দেন আবুল কালাম। তার চোখেমুখে শোক, ক্ষোভ আর আতঙ্ক ছিল স্পষ্ট।
তিনি বলেন, “আজকে আমাদেরকে জুলুম-নির্যাতনের দিন। সমাবেশে যুক্ত হয়ে পৃথিবীর কাছে বিচার চাচ্ছি। আমাদের জন্য বিচার কেউ করছে না। বিচার করে দিন। আর বাংলাদেশ-মিয়ানমার মিলে ফয়সালা করতে হবে আমাদের।”
উখিয়ার মধুছড়া থেকে সমাবেশে যোগ দিতে আসা মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, “সমাবেশে বলা হয়েছে, আমরা যেন সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে থাকি। আজকে আমাদের কালো দিন, সবাই মিলে একসঙ্গে পালন করছি। সীমান্ত পাড়ি দিলে আমরা একসঙ্গেই ফিরব।”
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নিহত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য বিশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা নুর হোসেন।
সমাবেশে রোহিঙ্গা ভাষায় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়, যার অর্থ ছিল: “আমরা গণহত্যার শিকার হয়েছি, আমরা গণহত্যা থেকে বেঁচে ফিরেছি। আমরা আমাদের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাই।”
সেখানে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ বলেন, “২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনে জড়িত সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”
রোহিঙ্গাদের ফেরাতে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ”আমাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে অসংখ্য মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে মিয়ানমার। অথচ নাগরিকত্ব আর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কোনো উদ্যোগ নেই তাদের। পরিবেশ ঠিক করলে আমরা সবাই একদিনেই চলে যেতে পারব।”
তরুণ প্রতিনিধির বক্তব্যে নূর হাকিম বলেন, “আমাদের শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ আমরা জানি না। ক্যাম্পে ছোট ছেলে-মেয়েদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দিলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে এমন অন্ধকার পরিবেশ থেকে মুক্তি দিতে হবে।”
এ সময় অন্যদের মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ, সহ-সভাপতি আবদুর রহিম, সংগঠনের প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল, শান্তি মহিলা সংস্থার নেত্রী হামিদা খাতুন বক্তব্য দেন।