এমবাসির গাড়িতে হলুদ রঙের ভুয়া নম্বরপ্লেট-সংবলিত যানবাহন তাদের। ওই গাড়ির সামনে বসে থাকবেন একজন সুন্দরী নারী ‘কর্মকর্তা’। শার্ট-প্যান্ট পরিহিত ওই ‘কর্মকর্তার’ হাতে থাকবে ওয়্যারলেস সেট। টার্গেট করে ইয়াবা কারবারিদের চালান ধরতে এমন আয়োজন রেখেই পাকড়াও করবে তারা। একপর্যায়ে প্রকৃত ওই ইয়াবা কারবারিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হবে চালান।
এভাবেই ইয়াবার চালান ধরার অভিনব ছক কষেছিল মাহবুব আলম ওরফে রেজা ওরফে আকাশ চৌধুরী নামের এক প্রতারক। গত ১০ আগস্ট এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগ। মাহবুব ছাড়াও অন্য দু’জন হলো রেজাউল করিম মিলন ওরফে রেজা ও বডিগার্ড নাসির। পলাতক রয়েছে এ চক্রের নারী সদস্য কানন।
দীর্ঘদিন ধরে গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরিচয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভিআইপি প্রটোকল নিয়ে ঘুরে বেড়াত এই চক্রের সদস্যরা। সংশ্নিষ্ট জেলার ডিসি, এসপি এবং ওসিদের অন্ধকারে রেখে এই প্রটোকল নিত তারা। চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো- একবার মাহবুব মাঠ পর্যায়ের এক সরকারি কর্মকর্তাকে জানায়, উত্তরাঞ্চলে সরকারি একটি কাজে তার সফর রয়েছে। যেন ফেরিঘাটসহ সর্বত্র তার জন্য ভিআইপি প্রটোকলের ব্যবস্থা রাখা হয়। পরে ওই ভিআইপি প্রটোকল ব্যবহার করে মাহবুব দৌলতদিয়া পতিতালয়ে যায় অসৎ উদ্দেশ্যে।
তিন প্রতারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ চক্রের মূল হোতা মাহবুব। সে কোথাও ‘মেজর’, কোথাও ‘র্যাবের কর্মকর্তা’ বলে পরিচয় দিয়ে আসছিল। প্রায় দেড় দশক ধরে নানা ধরনের প্রতারণায় যুক্ত সে। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে একটি শৃঙ্খলা বাহিনীতে ২০০১ সালে চাকরি নেয়। পরে বিষয়টি ধরা পড়ায় চাকরিচ্যুত হয়। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের পাইকপাড়ায়। বিয়ে করেছে তিনটি। ২০১৮ সালে প্রতারণা করে ১৪ বছর বয়সের এক স্কুলছাত্রীকে বিয়ে করে। পুরান ঢাকার ওই স্কুলছাত্রীর ভাই একটি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি ছিল। ওই মামলা থেকে তাকে বাঁচানোর কথা বলে স্কুলছাত্রীর বাবা ও অন্য স্বজনকে ম্যানেজ ও ভয়ভীতি দেখায়। গত বছরের এপ্রিলে কিশোরীকে বিয়ে করার পর জামাই হিসেবে বসবাস শুরু করে শ্বশুরের বাসায়। যৌতুক বাবদ আট লাখ টাকা দেওয়া হয় তাকে। পরে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর স্কুলছাত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়। ওই মামলায় গ্রেফতারের পর বেশ কয়েক মাস কারাগারে ছিল সে। সেখানে থাকাকালে আরেকটি হত্যা মামলার এক আসামির সঙ্গে সখ্য হয় তার। কারাগারে প্রায় সবাই জানত, মাহবুব একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। একটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছে তাকে। কিছুদিনের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে যাবে। পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে জেলখানায় পরিচয় হওয়া ওই হত্যা মামলার আসামির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের বাসায় গিয়ে মেজর বলে পরিচয় দেয়। কিছুদিন পর মাহবুব তাদের জানায়, যদি ওই হত্যা মামলার আসামির মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কারাগার থেকে মেয়েটির বাবাকে মুক্ত করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেবে সে। যখন ওই মেয়েটির বিয়ের প্রায় সব আয়োজন সম্পন্ন হচ্ছিল, তখনই তারা জানতে পারেন, মাহবুব ভুয়া মেজর।
মাহবুব আরও জানায়, ভুয়া গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরিচয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার এসপি ও ডিসিদের ফোন করত। তাদের বলত, কোনো একটি এলাকায় সে সরকারি সফরে
যাবে। সেখানে যেন তার জন্য সব ব্যবস্থা করে রাখা হয়। এমনকি বিভিন্ন ফেরিতে ভিআইপি প্রটোকলও নিত। সে তার টার্গেট করা ব্যক্তিদের কাছে বলত, গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে তার একটি অন্যতম দায়িত্ব ছিল বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার গোপন প্রতিবেদন তৈরি করা। সেই প্রতিবেদনের আলোকে পদোন্নতি হয়ে থাকে তাদের। এই কাজ করতে গিয়ে সরকারি অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্য হয়েছে। এমন টোপ ব্যবহার করে পদোন্নতিপ্রত্যাশী অনেক নারী কর্মকর্তার সঙ্গেও ‘সম্পর্ক’ তৈরি করে মাহবুব। তাদের মধ্যে কয়েকজন নারী চিকিৎসকও রয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিপক্ষকে অস্ত্র দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলে একাধিক জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছে মাহবুব। ব্যাংক থেকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে অনেকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সে।
জানা গেছে, মাহবুবের অন্যতম সহযোগী রেজা। একসময় ঢাকায় মিসর দূতাবাসে চাকরি করত সে। সেখান থেকে চাকরি যাওয়ার পর বাড্ডা এলাকায় একটি অফিস খুলে বসে। তার অফিসে নিয়মিত যাতায়াত ছিল মাহবুবের। বিদেশে গমনেচ্ছুদের ভিসা প্রসেসিংয়ের কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ দু’জন।
মাহবুবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা এলাকার এক তরুণের সঙ্গে কারাগারে পরিচয় হয় তার। মাদকাসক্ত ওই তরুণকে তার পরিবার নিজেরাই পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। ওই মামলায় জামিন লাভের পর মাহবুব উত্তরা এলাকা থেকে তাকে একদিন ডেকে আনে। তাকে একটি প্যাকেট দিয়ে বলে, এতে পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা রয়েছে। যেন দ্রুত ওই বড়ি খুচরা বিক্রি করে তার হাতে টাকা পৌঁছে দেয় সে। তখন ওই তরুণ জানায়, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ইয়াবার সঙ্গে তার কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই। ওই ইয়াবা বিক্রির প্রস্তাব নাকচ করে সে। এরপর মাহবুব ওই তরুণকে ভয় দেখায়, যদি সে ইয়াবা বিক্রি করতে রাজি না হয়, তাহলে এখনই র্যাবের হাতে তাকে তুলে দেওয়া হবে। কারণ, র্যাবের একটি দল মাহবুবকে অনুসরণ করছে। এ ভয় দেখিয়ে ওই তরুণের মোটরসাইকেল ও মোবাইল নিয়ে সটকে পড়ে মাহবুব। পরে ওই ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করা হয়। মাহবুব জানায়, ইয়াবার যে প্যাকেট দিয়ে তরুণকে ফাঁসানো হয়েছিল, আসলে তা ছিল ফাঁকা। সেখানে কোনো ইয়াবা ছিল না।
ডিবির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মাহবুবের হেফাজত থেকে বিভিন্ন বাহিনীর ভুয়া কার্ড পাওয়া গেছে। ওই কার্ডে নিজের মতো পদবি ব্যবহার করে পরিচয় দিত সে। এ ছাড়া অনেককে বলত, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ পদে তার একাধিক ‘মামা’ রয়েছে। মাহবুব কখনও বলত তার কর্মস্থল গণভবন। কখনও বলত র্যাব। কখনও বলত, গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে মোহাম্মদপুর, বছিলা, আমিনবাজার এলাকার দায়িত্বে রয়েছে সে।
পুরান ঢাকার যে তরুণীকে মাহবুব বিয়ে করেছিল, তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘ছেলে একটি মামলায় ফেঁসে গিয়েছিল। ওই মামলা থেকে বাঁচাতে মাহবুবের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তখন জানতাম, সে বড় অফিসার। পরে ভয় দেখিয়ে আমার কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করে সে। সে যে ক্ষতি করেছে, তা অপূরণীয়। ওই ঘটনার পর আমার পরিবারের সবাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। যেন আর কারও পরিবার এমন প্রতারণার শিকার না হয়।’
ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ‘মাহবুবের প্রতারণার খপ্পরে এরই মধ্যে অনেকেই পড়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। অনেকে আর্থিকভাবেও ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তার সব সাঙ্গোপাঙ্গকে ধরার চেষ্টা চলছে।’
ডিবির উত্তরা জোনাল টিমের এডিসি বদরুজ্জামান জিল্লু বলেন, ‘কেউ অন্যায়ভাবে তদবিরের ফাঁদ পাতলে তাতে পা দেওয়া কারও উচিত হবে না। এতে বড় ধরনের ঝুঁকি থাকে।’