জাতীয় সংসদ ভবনকে বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই ইসাডোর কানের মূল নকশায় ফেরানোর কাজে হাত দেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে মূল ভবনের অস্থায়ী শতাধিক কক্ষ ভেঙে ফেলার কাজ সেপ্টেম্বরেই শুরু করতে যাচ্ছে সংসদ সচিবালয়। অস্থায়ী কক্ষের বর্তমান অফিসগুলো মূল ভবনের বাইরে সচিব হোস্টেলে স্থানান্তর করা হবে। সেখানে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আগামী ৮ সেপ্টেম্বর একাদশ সংসদের চতুর্থ অধিবেশন শুরু হবে। যার মেয়াদ খুবই সংক্ষিপ্ত হওয়ার আভাস মিলেছে। এই অধিবেশন শেষ . হওয়ার পরপরই এসব কক্ষ ভাঙার কাজ শুরু হতে পারে। তবে কতগুলো কক্ষ ভাঙা হবে সে ব্যাপারে এখনও কিছু নিশ্চিত করা যায়নি। এ ছাড়া সংসদের সীমানায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর এবং স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনসহ অন্যান্য স্থাপনার বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিদেশ থেকে মূল নকশা সংগ্রহের পরও জিয়ার কবর সংসদের সীমানায় পড়েছে কি-না, তা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি স্থাপত্য অধিদপ্তর।
মূল নকশায় ফেরার উদ্যোগ সম্পর্কে সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, মূল ভবনের অভ্যন্তরে অস্থায়ী কক্ষগুলো পর্যায়ক্রমে সরিয়ে নেওয়া হবে। চেষ্টা থাকবে যতদূর সম্ভব লুই কানের মূল নকশায় ফিরে যাওয়ার। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে সংসদের ভেতরে কাঠের প্রাচীর দিয়ে অস্থায়ী কক্ষগুলো তৈরি করা হয়েছিল। সংসদের কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত এমন বিভাগগুলো রেখে বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি জানান, সচিব হোস্টেলে অবস্থানরতদের সরিয়ে নেওয়া এবং সংসদের অন্যদের আবাসনের জন্য পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে ৫০০ ফ্ল্যাট চাওয়া হবে। এসব ফ্ল্যাট পাওয়া গেলে সচিব হোস্টেল খালি করে সেখানেই কিছু অফিস স্থানান্তর করা হবে।
স্থপতি লুই কান প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ ভবনের নকশা করেছেন। ভবনের ছাদে ব্যবহার করা হয়েছে কাচের ইট। বাতাস ও সূর্যের আলো যাতে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে, সে জন্য প্রতি ব্লকের চার ভাগের এক ভাগ খালি বা ভয়েড হিসেবে রাখা হয়েছে- যাতে বৈদ্যুতিক আলো ছাড়াই দিনের বেলায় কাজ করা যায়। কিন্তু বর্তমানে সংসদ ভবনে বৈদ্যুতিক আলো ছাড়া কাজ করার সুযোগ নেই। কারণ আলো ও বাতাস ঢোকার বেশির ভাগ পথ বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির ফলে। এমনকি লেকের পাড়ে অবস্থিত কক্ষগুলোর বেশিরভাগেও এখন দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ছাড়া অন্ধকার থাকে।
৫৮ হাজার ৩২৭ দশমিক ৫৯ বর্গমিটার এলাকায় অবস্থিত সংসদ এলাকার মধ্যে পার্লামেন্ট ভবনের অবস্থান তিন দশমিক ৪৪ একর জমিতে। পাশাপাশি উত্তর প্লাজা এক দশমিক ৪৬ একর, দক্ষিণ প্লাজা চার দশমিক ৯৮ একর এবং বাকি জমিতে আবাসিক ভবন, হোস্টেল, বাগান, রাস্তা, লেক ইত্যাদি রয়েছে। ভবন কমপ্লেক্সে ৫০টি সোপান, ৩৪০টি শৌচাগার, এক হাজার ৬৩৫টি দরজা, ৩৩৫টি জানালা, ৩০০টি পার্টিশন দেয়াল, তিন হাজার ৩৩০ দশমিক ৫৭ বর্গমিটার কাচের শাটার, পাঁচ হাজার ৪৩৪ দশমিক ৮৩ বর্গমিটার কাঠের শাটার এবং তিন হাজার ৭৩৮ ঘনমিটার কাঠের প্যানেল রয়েছে। ভবনের সর্বোচ্চ তলাটি বা লেভেল ১০ ব্যবহার্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতির জন্য নির্ধারিত।
গণপূর্ত বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, লুই কানের নকশায় ভবনের কক্ষের সংখ্যা থাকার কথা ৪শ’। কিন্তু এখন আছে ৫শ’রও বেশি। বড় কক্ষগুলোতে কাঠের বিভাজন দিয়ে অনেক ছোট কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। এই ভবনে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলেও নকশাবহির্ভূত এসব কক্ষের জানালার পাশে আলাদা শীতাতপ যন্ত্র লাগানো হয়েছে। এটা করতে গিয়ে অনেক জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম ব্লকে সচিবের কক্ষের সামনের উন্মুক্ত জায়গা কাচ দিয়ে ঘিরে নতুন একটি কক্ষ বানানো হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে আলোকিত এই জায়গাটি এখন প্রায়-অন্ধকার।
সংসদের গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুল হক বলেন, প্রাথমিকভাবে কতগুলো কক্ষ ভাঙা হবে তা এখনও যাচাই-বাছাই করা হয়নি। তবে লাইটিং এরিয়া বন্ধ করে বানানো কক্ষগুলো ভাঙার বিষয়ে নির্দেশনা পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, আগামী অধিবেশন শেষ হওয়ার পরপরই অস্থায়ী কক্ষ ভাঙার কাজ শুরুর আশা করা যাচ্ছে। তবে ১৫ সেপ্টেম্বরের আগে শুরু করার সম্ভাবনা নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অস্থায়ী কক্ষে এখন যেসব অফিস রয়েছে সেগুলো সচিব হোস্টেলে স্থানান্তরের কথা রয়েছে। সচিব হোস্টেলে এখন যেসব কর্মকর্তা অবস্থান করছেন তাদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য গণপূর্তের কাছে কিছু ফ্ল্যাট চাওয়া হয়েছে। তাদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, স্থাপত্য অধিদপ্তর নকশা যাচাই-বাছাইয়ের পর বলা যাবে কতগুলো কক্ষ নকশার বাইরে রয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই সংসদের ভেতরে-বাইরে জিয়ার কবর অপসারণের বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা সামনে আসে। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে রাজনৈতিক মাঠও গরম করেছেন রাজনীতিবিদরা। জুলাইয়ে শেষ হওয়া সর্বশেষ বাজেট অধিবেশনেও জিয়ার কবর সরিয়ে নেওয়ার দাবি তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
২০১৪ সালে এ নিয়ে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত মূল নকশা সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় সংসদ সচিবালয়। সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়, মূল নকশা হাতে পাওয়ার পরেই জিয়ার কবর সরানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর এই নকশা প্রধানমন্ত্রীকে দেখানো হয়। এরপর ওই নকশার কপি ন্যাশনাল আর্কাইভ, স্থাপত্য অধিদপ্তর ও সংসদ সচিবালয়ে সংরক্ষণের জন্য রাখা হয়।
মূল নকশা প্রধানমন্ত্রীকে প্রদর্শনের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির। তিনি জানিয়েছেন, সংসদের মূল নকশার কপি তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে তারা সরকার বা সংসদের কাছ থেকে কোনো লিখিত নির্দেশনা এখনও পাননি। তাই নকশা অনুযায়ী মূল ভবনের মধ্যে বা সংসদের সীমানায় নকশাবহির্ভূত স্থাপনা কোনটি, তা যাচাই-বাছাই করা হয়নি। জিয়ার কবর সংসদের নকশার মধ্যে রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া কিছুই বলা সম্ভব নয়।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীকে নকশা প্রদর্শনের দিন বলা হয়েছিল মূল নকশায় সংসদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি মসজিদ নির্মাণের কথা। তবে এর আকার খুবই ছোট। কিন্তু যে কোনো কারণে সেটা হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড় আকারের মসজিদ করার পক্ষে মত দিয়ে বলেছিলেন, ওই স্থানে প্রতিবন্ধীদের জন্য রক্ষিত স্কুলের জমি অন্য স্থান থেকে দেওয়া হয়েছে। তাই সেখানে বড় আকারেই মসজিদ করা যেতে পারে। বর্তমানে ওই স্থানটি ফাঁকা থাকলেও সেখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত সাইনবোর্ড টানানো রয়েছে।
এ ছাড়াও চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সংসদ কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে দীর্ঘদিন আটকে থাকা সংসদের ৭ নম্বর গেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে কমিটির সদস্যরা ছাড়াও সাবেক দুই চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ ও আ স ম ফিরোজ বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নিয়েছিলেন। এই গেটের বিপরীতে চন্দ্রিমা উদ্যানেই জিয়ার কবর রয়েছে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ওই গেট দিয়ে শুধু এমপি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও মন্ত্রীর মর্যাদার ব্যক্তিরা চলাচল করবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, কতটুকু কী সরানো হবে সে সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সংসদ নেতার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। তবে এ নিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। চিফ হুইপ এখন দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি দেশে ফেরার পর সংসদ নেতার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, সংসদের চারপাশ আরও গোছালো করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জিয়ার কবরসহ অন্যান্য স্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন বলেন, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই। সংসদের মূল নকশা পাওয়ার পর সেটির দুটি সেট সংসদে রাখা হয়েছে। অন্যগুলো গণপূর্ত এবং ন্যাশনাল আর্কাইভে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সংসদের ভেতর পরিবর্তন আনার বিষয়ে স্পিকার বলেন, সংসদের চিফ হুইপ সংসদ কমিটির বৈঠকে পূর্ত বিভাগের নির্মিত মিরপুর, আদাবর, লালমাটিয়ার কিছু ফ্ল্যাট সংসদ সচিবালয়ের পক্ষ থেকে চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সংসদ সচিবালয়ের জন্য আগারগাঁওয়ে এখন ৪৪৮ ফ্ল্যাটের একটি কমপ্লেক্স রয়েছে। কিন্তু সংসদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা এক হাজার তিনশ’র বেশি। কিছু ফ্ল্যাট পাওয়া গেলে সচিব হোস্টেলে অবস্থানরতদের স্থানান্তর করে সেখানে কিছু অফিস নেওয়া হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্পেস বাড়ানো সম্ভব হলে কাঠের পার্টিশন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী কক্ষগুলো সরিয়ে ফেলা হবে, যাতে সংসদের সৌন্দর্য ঠিক থাকে। তবে পুরোপুরি আগের নকশায় ফেরার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে স্পিকার বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেক। এ কারণেই এসব অস্থায়ী কক্ষ বানানো হয়েছে। কতটা সরানো সম্ভব হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
চিফ হুইপের উদ্ৃব্দতি দিয়ে স্পিকার আরও বলেন, পার্লামেন্ট ক্লাবের সামনে ব্যারাক তৈরি করে এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের রাখা হচ্ছে। তাদের সরিয়ে নিতে মণিপুরিপাড়ায় গণপূর্তের একটি জায়গা রয়েছে। সেখানে ফ্ল্যাট তৈরির বিষয়েও আলোচনা রয়েছে।
এর আগে ২০১৩ সালে সংসদের মূল ভবনের উত্তর ফটক বন্ধ করে দিয়ে সংসদ টেলিভিশনের জন্য স্টুডিও তৈরি করা হয়েছিল। সমালোচনার মুখে পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেও উত্তর ফটকটি এখনও বন্ধ রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সেখানে তৈরি ইটের প্রাচীর অপসারণ করা হয়নি। স্টুডিও তৈরির জন্য নির্ধারিত কক্ষে এখন বিভিন্ন অব্যবহূত জিনিস ফেলে রাখা হয়েছে। দিনের আলো প্রবেশের কোনো সুযোগ সেখানে নেই।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংসদ এলাকায় মূল নকশাবহির্ভূতভাবে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন তৈরি করা হয়। ২০০২ সালে বাড়ি নির্মাণ শুরু হলে পরিবেশবাদীরা আদালতের আশ্রয় নেন। স্থাপনা নির্মাণের ওপর আদালত থেকে স্থগিতাদেশ দেওয়ার পরও নির্মাণকাজ চলতে থাকে। ২০০৪ সালে আদালতের এক রায়ে বলা হয়, সংসদ ভবন এলাকায় নকশাবহির্ভূত যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বেআইনি। ওই সরকারের আমলেই এ বাসভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়। তবে ২০১১ সালে তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ ও ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী প্রথমবারের মতো ওই বাসভবনে ওঠেন।