বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় বিভিন্ন দলের নেতারা বলেছেন, সরকারকে হটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে। এ লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়েই রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তারা বলেন, দেশ ও গণতন্ত্রের প্রয়োজনে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। আন্দোলন সফল করতে দলগুলোকে আরও সুসংহত করতে হবে।
রোববার বিএনপির ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এ সভার আয়োজন করা হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছেন দলের নেতাকর্মীরা।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সভায় সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপির জন্ম হয়েছিল আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক শূন্যতার কারণে। সেই শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগই। সেই শূন্যতা কাটাতে দেশপ্রেমিক মানুষকে নিয়ে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। সুতরাং বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তায়। জন্মের ৪০ বছর পরও সেই দলের প্রয়োজনীয়তা একই রকম রয়েছে।
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আসুন, এই দিনে শপথ নিই। বিএনপিকে সুসংগঠিত করব। বিশ্বাস করি, খুব অল্প সময়ের মধ্যে সংগঠিত হবে। আর যারা গণতন্ত্র বিশ্বাস করে, সেসব দলকে নিয়ে জনগণের সরকার ও সংসদ গঠন করতে সক্ষম হবো। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। লড়াই ও সংগ্রাম করে তাকে বের করে আনতে হবে এবং গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে খুব পরিষ্কার করে বলেছি, নির্বাচনকে বাতিল করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। এই নির্বাচন হবে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই এবং রোহিঙ্গা ও ডেঙ্গু সমস্যায় জরাজীর্ণ। এসব কারণে বাংলাদেশে আজ ক্রান্তিকাল চলছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার একা হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক কোনো জায়গা থেকে সমর্থন পাচ্ছে না।
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, দলের মধ্যে এবং অঙ্গ-সংগঠনগুলোকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পুনর্গঠন করে সময়মতো শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সরকারকে হটিয়ে দেশকে বাঁচাতে হবে।
দলের স্থায়ী কমিটির অপর সিনিয়র সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, দেশে সংকটকাল চলছে। অনেকেই অস্থির ও হতাশ। সবাই জানতে চাইছে, ১২ বছর হলো, আর কত সময় অপেক্ষা করব। কিন্তু এটা খুব অল্প সময়। প্রয়োজন হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে। এই সরকারের পতন হবেই।
ব্যারিস্টার মওদুদ আরও বলেন, আজকে বিচার বিভাগে নির্যাতন শুরু হয়েছে। আগে পুলিশের মাধ্যমে নির্যাতন-নিপীড়ন করত সরকার। এখন শুরু হয়েছে বিচারিক নির্যাতন। বিরোধী দল করলে এখন আর ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। নীতিনৈতিকতা বলতে দেশে আর কিছু নেই। এ কারণে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে রাখতে সক্ষম হয়েছে। খালেদা জিয়াসহ অন্য নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে কারাগারে রাখা হয়েছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, বিএনপিসহ নিজেদের অতীত ভুল সামনে রেখে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবে ঘরে বসে আন্দোলন করলে খালেদা জিয়া আর গণতন্ত্রের মুক্তি সম্ভব হবে না। কোনো একক দলের পক্ষে আন্দোলন করে এই সরকারের পতন হবে না। তাই সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠায়, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাকশাল যদি প্রতিষ্ঠিত করা যেত, তাহলে দেশ আরও উন্নত হতো। সুতরাং যিনি বাকশালের কথা বলেন, তার কাছে গণতন্ত্র আশা করা নিষ্ম্ফল। তাই আন্দোলন-সংগ্রামের বিকল্প নেই। আসুন, আমরা গণতন্ত্রের মুক্তির সংগ্রাম করি। কারণ, গণতন্ত্রের মুক্তির পথে যে বাধা, খালেদা জিয়ার মুক্তির পথেও সে বাধা। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না। ঘরে বসে থাকার সময় নেই।
স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে চলেছে। আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অর্থনীতি দেউলিয়ার পথে। এ থেকে মুক্তির জন্য খালেদা জিয়াকে আগে মুক্ত করতে হবে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আজকে বাংলাদেশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শূন্যতায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই শূন্যতা দূর করতে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। এ জন্য আজ একতার কথা বলা হচ্ছে। আর একতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণ এই একতায় এসে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির নির্যাতিত নেতারা এবং যারা ভোট দিতে পারেননি, তারা আজ একতাবদ্ধ।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও খালেদা জিয়ার মুক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি এখন আর বিএনপির একক দাবি নয়। এটা সারাদেশের জনগণের দাবি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি। তাই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিষ্ফ্ক্রিয় হয়নি। খুব শিগগির তা দৃশ্যমান হবে বলেও তিনি জানান। খালেদা জিয়ার সাহসের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আমি ওনাকে (খালেদা জিয়া) স্যালুট জানাই।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি ও সহপ্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিমের সঞ্চালনায় সভায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ ২০ দলীয় জোট নেতা, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহম্মদ ইসহাক, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, মাওলানা নুর হোসেন কাশেমী, সাইফুদ্দিন মনি, খন্দকার লুৎফর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
জিয়ার কবরে শ্রদ্ধা: সারাদেশে বিএনপির ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছেন দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। দিবসটি উপলক্ষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সিনিয়র নেতাদের নিয়ে সকাল সোয়া ১০টায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেন। এ সময় ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, কৃষক দল, তাঁতী দল ও মুক্তিযোদ্ধা দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড-ব্যানার নিয়ে জিয়ার সমাধি এলাকায় জমায়েত হন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে সম্পূর্ণভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচন চাই। এ দুটি দাবিতে আন্দোলন করছি এবং আন্দোলন আরও বেগবান হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালনে পুলিশ বাধা দিয়েছে। কোথাও কোথাও কর্মসূচিই করতে দেওয়া হয়নি। দলের পক্ষ থেকে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান তিনি।
সোমবার বর্ণাঢ্য র্যািলি: বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে আগামীকাল সোমবার দুপুর ২টায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করবে দলটি। দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে শোভাযাত্রা নাইটিংগেল মোড় হয়ে মালিবাগ রেলগেট ও মগবাজার অভিমুখে রওনা হবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।