স্বামী-স্ত্রী দু’জনই চাকরিজীবী। স্ত্রী ফারহা নাজের (২৭) অফিস রাজধানীর মহাখালী এবং স্বামী নাজমুল হাসান কর্মরত খিলক্ষেতে বিদ্যুতায়ন বোর্ডে। প্রতিদিনই মিরপুরের মনিপুরের বাসা থেকে দু’জন একসঙ্গে অফিসের উদ্দেশে বের হন মোটরসাইকেলে। স্ত্রীকে মহাখালী এলাকায় নামিয়ে খিলক্ষেতে নিজের কর্মস্থলে যান নাজমুল। গতকাল বৃহস্পতিবারও সকাল পৌনে ৯টার দিকে মহাখালী ফ্লাইওভারের চেয়ারম্যান বাড়ি দিকের ঢালে নামিয়ে দেন স্ত্রীকে। স্বামী চলে যাওয়ার পর আমতলী-চেয়ারম্যান বাড়ির মাঝামাঝি ফ্লাইওভারের পাশের রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে ওঠেন ফারহা নাজ। এ সময় আমতলী মোড়ে একটি বাস ঘুরিয়ে কাকলীর দিকে যাওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেয় তাকে। এতে প্রাণ হারান তিনি। একই ঘটনায় কাওসার মোস্তফা নামে এক ব্যক্তি আহত হন। বাসটি জব্দ করেছে পুলিশ। তবে চালক পালিয়েছে।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট বাংলামটর এলাকায় নিজের অফিসের উল্টো পাশের সড়কের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন কৃষ্ণা রায় নামে এক নারী। ওই সময়ে ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্টের একটি বাস ফুটপাতে উঠে ধাক্কা দেয় তাকে। উদ্ধার করে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। দুই দফা অস্ত্রোপচারে বাঁ পা ঊরু পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয় তার। ওই মর্মন্তুদ ঘটনার পর আবার রাজপথে প্রাণ গেল এক কর্মজীবী নারীর।
ফারহা নাজের বোনের স্বামী সরফরাজ জানান, নাজমুল-ফারহা নাজ দম্পতির তাহরিন হাসান ইসরা নামে ছোট্ট কন্যাসন্তান আছে। ফারহা নাজ মহাখালীর আমতলীতে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। একই সঙ্গে অফিসে যাওয়া-আসা করতেন স্বামী-স্ত্রী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে ফ্লাইওভারে ঢাল থেকে রাস্তা পার হয়ে ফারহা নাজ ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট মিনিবাস সার্ভিসের (মিরপুর ১৪ নম্বর) একটি বাস ইউটার্ন করে আমতলী মোড় ঘুরে কাকলীর দিকে যাচ্ছিল। বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রথমে ফুটপাতে ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা দেয়। ল্যাম্পপোস্টটি দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে এক যুবক প্রথমে ছিটকে পড়েন। গাড়ির গতি এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, ফুটপাত ঘেঁষে আরও ২০-২৫ গজ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ফারহা নাজ সরে যাওয়ারও সময় পাননি। তাকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বাসটি। তার মাথা ফেটে রক্তাক্ত হয়। একই সঙ্গে আহত হন কাওসার মোস্তফা নামে আরেক ব্যক্তি। প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানান, পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফারহা নাজ অচেতন হয়ে পড়েন। তার চোখেমুখে পানি ছিটানো হয়। এর পরও সাড়া পাওয়া যায়নি তার। অচেতন অবস্থায় কয়েকজন পথচারী ফারহা নাজসহ দু’জনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মৃত্যু হয়েছে ফারহা নাজের। পরে লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। বিকেলে ময়নাতদন্ত করা হয়। সেখান থেকে লাশ নেওয়া হয় মিরপুরের মনিপুরের বাসায়। স্বজনরা ভিড় করে লাশ দেখতে। শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয় সেখানে। ফারহা নাজের দেড় বছরের শিশুটি এখনও বোঝেওনি চিরদিনের জন্য মাকে হারাতে হলো তাকে। স্বজনরা জানিয়েছেন, ফারহা নাজ অফিস শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট মেয়ে ছুটে আসত মায়ের কোলে। কিন্তু গতকাল ফেরেননি তার মমতাময়ী মা। রাতেও মায়ের দেখা না পেয়ে কান্না শুরু করে শিশুটি। স্বজনরা চেষ্টা করেন তার কান্না থামাতে।
পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, রাত ১০টার দিকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে লাশের দাফন সম্পন্ন করা হয়। তার বাবার নাম মো. ইসরাইল। গ্রামের বাড়ি ঢাকার ধামরাইয়ের বাথুলি এলাকায়। তবে তার বাবা-মা বসবাস করেন ডেমরার কোনাপাড়ায়। এদিকে আহত কাওসারকে হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের মহাখালী জোনের সহকারী কমিশনার সুবীর রঞ্জন দাস বলেন, ‘বাসটি ঘোরানোর পরও গতি অনেক বেশি ছিল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রথমে রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা মারে। এর পরও থামেনি বাসটি। ফুটপাত ঘেঁষে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। পরে চালক বাস রেখে পালিয়ে যায়।’
বনানী থানার এসআই আফজাল হোসেন জানান, বাসটি জব্দ করা হয়েছে। চালকের নাম শামীম মিয়া (২৫)। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের সখিপুর থানার চরকুমারিয়া গ্রামে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় গতকাল রাতে নিহতের স্বামী নাজমুল বাদী হয়ে চালকের বিরুদ্ধে মামলা করেন।