মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার পরিকল্পনা করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এর বিরোধিতা করছেন শিক্ষকরা। শিগগিরই তারা এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবকে স্মারকলিপি দেবেন। এভাবে বেতন নেওয়াকে অসম্মানজনক বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষকদের বক্তব্য, এভাবে বেতন দেওয়া হলে পাড়া-মহল্লার পান দোকানে গিয়ে তাদের টাকা তুলতে হবে। এটি অসম্মানের। দ্বিতীয়ত, প্রতারণার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বলেন, শিক্ষকদের বেতন কোনোভাবেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হবে না। বর্তমানে যেভাবে দেওয়া হচ্ছে, সেভাবেই দেওয়া হবে।
সারাদেশে ৬৫ হাজার ৯০১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ শিক্ষক কর্মরত। বর্তমানে তারা নিজ নিজ ব্যাংক হিসাব নম্বরে বেতন পান। জানা গেছে, গত বুধবার রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন তাদের মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিশোধে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিলেও বিষয়টি তাদের সক্রিয় বিবেচনাধীন। যে ব্যাংকটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছে,
তারা এর আগে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান কার্যক্রমেও যুক্ত ছিল। সেখানে অবশ্য নানা অনিয়মের অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে এসে জমা হয়। এর মধ্যেই আবার নতুন এ প্রস্তাব দেওয়া হলো।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর মতোই সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে নিম্ন পদের বা চুক্তিভিত্তিক কিছু কর্মচারীর বেতন বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়ে থাকে। এ বিষয়টি তুলে ধরে শিক্ষকরা এভাবে বেতন নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তা তুলে ধরেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের মার্চে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে নানান জটিলতায় এখনও তার বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদমর্যাদা অনেক উন্নীত হয়েছে। শিগগিরই তারা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হতে যাচ্ছেন।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বেতন দেওয়ার বিরোধিতার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি শামছুদ্দিন মাসুদ বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকরা ব্যাংক একাউন্টে বেতন পাওয়াকে সম্মানজনক মনে করেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নানাভাবে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। পিন নম্বর চুরি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় এভাবে বেতন পাওয়াকে কেউই নিরাপদ মনে করছেন না। প্রাথমিক শিক্ষকরা সরকারের স্বল্প বেতনভোগী। কোনোক্রমে কোনো মাসের বেতন প্রতারকের হাতে গেলে পুরো মাস ভীষণ কষ্টে যাবে। আমাদের বেতন ব্যাংকেই নিরাপদ। তা ছাড়া এটিএম কার্ড থাকায় ব্যাংকে এখন সময়ও কম লাগে। এই শিক্ষক নেতা বলেন, তারা চান প্রচলিত ব্যবস্থাতেই তাদের বেতন দেওয়া হোক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের মনোভাব একই রকম। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক দিদারুল আলম বলেন, যে ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাদের এর আগে উপবৃত্তি বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাতে তারা ঘাপলা করেছে। এখনও অনেক সময় অভিভাবকরা সন্তানের উপবৃত্তির টাকা তুলতে পারেন না। আবার প্রতি শ’তে ১০/২০ টাকা কেটে নেওয়া হয়। শিক্ষকদের বেতন এভাবে দেওয়ার দরকার নেই। ব্যাংক থেকে যেভাবে টাকা উত্তোলন করছি, সেটাই উত্তম। তিনি বলেন, মোবাইল ফোনের দোকানে গিয়ে এভাবে বেতন তোলা শিক্ষকদের জন্য অবমাননাকর।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাসন্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, শিক্ষকতা সম্মানজনক পেশা। আর একজন শিক্ষক ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে বেতন উত্তোলন করবেন- এটা অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার হবে।
সিলেটের মৈশাষী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকদের বেতন-ভাতাসহ যে কোনো লেনদেনের জন্য অসংখ্য ব্যাংক থাকতে কেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন দিতে হবে? শিক্ষকরা কি কেউ এটা চেয়েছেন? এ শিক্ষক বলেন, এর আগে শিশুদের উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে দিতে গিয়ে চরম ঝক্কি পোহাতে হয় শিক্ষকদের। উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিশুদের তালিকা করে মাসভিত্তিক চাহিদা সার্ভারে আপলোড করা, শিশুর মা-বাবা ও সব অভিভাবকের ছবি, এনআইডি কার্ড ও সব শিশুর জন্ম নিবন্ধন কার্ড সংগ্রহ ও ফরম পূরণ করে ফাইল আকারে উপজেলা শিক্ষা অফিসে জমা দিতে হয়। আবার এসব কাজে কোনো ভাতাও দেওয়া হয় না। এতে শিক্ষক-অভিভাবকদের প্রচুর সময় ও শ্রম দিতে হয়। তা ছাড়া শিশুদের পড়ালেখায়ও ব্যাঘাত ঘটে।