নতুন ব্যাংকের জন্য কোনো আবেদন আহ্বান করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতা আবুল কাশেম যে পিপলস নামে একটি ব্যাংক পাচ্ছেন, তা নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন বেশ আগেই। এ জন্য ব্যাংকের মূলধন জোগান করতে ধরনা দিয়েছেন অনেকের কাছেই। এ সুযোগে ব্যাংক পরিচালক হতে ঋণের টাকাও মূলধন হিসেবে জমা হয়েছে। এতেই আটকে গেছে ব্যাংকটির চূড়ান্ত অনুমোদন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ১৭ ফেব্রুয়ারির পরিচালনা পর্ষদের সভায় বেঙ্গল কমার্শিয়াল, সিটিজেন ও পিপলস নামে নতুন তিনটি ব্যাংকের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে কেবল পিপলস ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রক্রিয়া আটকে গেছে। এ ব্যাংকে উদ্যোক্তা হিসেবে আরও রয়েছেন মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আলিম খান, তমা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক মুকিতুর রহমান, খান ব্রাদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তোফায়েল কবির খান, কার সিলেকশনের কর্ণধার আসলাম সেরনিয়াবাতসহ দেশি ও প্রবাসী বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। বর্তমানে নতুন ব্যাংক করতে ৪০০ কোটি টাকা মূলধন লাগে।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে ধরা পড়ে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পিপলস ব্যাংকে ১০ কোটি টাকা মূলধন বিনিয়োগ করেছিলেন শহীদুল আহসান, যিনি নিজেও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একজন পরিচালক। এর মাধ্যমে তাঁর মালিকানাধীন এজি অ্যাগ্রোর প্রতিনিধি হিসেবে মেয়ে রাহনুমা আহসানকে পরিচালক করতে চেয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী, কর পরিশোধ করা আয়কেই শুধু মূলধন হিসাবে দেখানো যায়।
প্রস্তাবিত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম এ নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। গত শনিবার ব্যাংকটির কার্যালয়ে তিনি বলেন, আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখবে। অবশ্য এখন রাহনুমা আহসানকে বাদ দিয়ে নতুন ব্যবসায়ী গ্রুপকে যুক্ত করে ব্যাংকটির চূড়ান্ত অনুমোদনের চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ নিয়ে বলেন, ব্যাংকটির আবেদনের নথিপত্রে কিছু সমস্যা আছে। তাই ব্যাংকটির চূড়ান্ত অনুমোদন আটকে আছে।
ঋণ যেভাবে মূলধন
বিএফআইইউর তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আবুল কাশেম পাঁচটি হিসাব খুলেছিলেন মার্কেন্টাইল, প্রিমিয়ার, যমুনা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকে। এসব হিসাবেই গত বছরের ১৪ থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা জমা হয়। আবুল কাশেম জানান, এজি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিনিধি রাহনুমা আহসানের কাছ থেকে মূলধন হিসেবে এই টাকা নিয়েছেন তিনি। এজি অ্যাগ্রো আহসান গ্রুপেরই একটি প্রতিষ্ঠান।
বিএফআইইউয়ের তদন্তে বলা হয়েছে, আহসান গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এজি গ্রিন প্রোপার্টিজের নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের গুলশান শাখার হিসাব থেকে ওই টাকা নগদে উত্তোলন করা হয়। এরপরই তা আবুল কাশেমের হিসাবে জমা হয়। আবার মার্কেন্টাইল ব্যাংকের গুলশান শাখায় টাকাগুলো এসেছিল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বনানী শাখার ইস্যু করা পে-অর্ডারের মাধ্যমে। নির্মাণসামগ্রী কেনার জন্য ঋণ হিসেবে ওই টাকা দেয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
এজি গ্রিন প্রোপার্টিজের নামে বনানী শাখায় ১৪৫ কোটি টাকার একটি ঋণ অনুমোদন করা আছে। ঋণ অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী, এ সুবিধা ব্যবহার হবে শুধু বিভিন্ন নির্মাণকাজের মালামাল কেনার জন্য। আর মালামাল পাওয়ার পরই ব্যাংক পে-অর্ডারের মাধ্যমে এ টাকা শোধ করবে। তবে এ ক্ষেত্রে মালামাল কেনা হয়নি।
আরও যত অনিয়ম
ফার্স্ট সিকিউরিটির বনানী শাখা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারিতে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে আহসান সিটি সেন্টারের নির্মাণসামগ্রী কেনার জন্য টাকা নিয়েছিল কোম্পানিটি। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নিয়ম না মেনে এজি গ্রিন প্রোপার্টিজ ঋণের টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করেছে। গত সপ্তাহে ব্যাংকটির বনানী শাখায় গেলে ব্যবস্থাপক তাহরুল হক তাদের গ্রাহক এজি গ্রিন প্রোপার্টিজকে ‘ভালো গ্রাহক’ হিসেবে উল্লেখ করে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শহীদুল আহসান বলেন, ‘আমরা শুরুতে প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের সঙ্গে ছিলাম। এখন আর নেই। টাকা ফিরিয়ে নিয়েছি।’
যদিও তাঁর বিষয়ে বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার গ্রাহক মিশ ম্যাক শিপ ব্রেকিং জাহাজ আমদানির আড়ালে সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাই ও উত্তর আমেরিকার নেভিসে ১৪৮ কোটি টাকা পাচার করে এবং বিল ক্রয়ের মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। আত্মসাৎ করা ওই অর্থ জমা হয় শহীদুল আহসানের প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডস ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে।
২০০৯ সাল থেকে বর্তমান মহাজোট সরকারের তিন মেয়াদে এখন পর্যন্ত ১৪টি বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংক বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৬২টি।