জাতীয় পার্টিতে (জাপা) ক্ষমতার লড়াই অব্যাহত রয়েছে। চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের বিরোধ মেটার আভাস নেই। বরং রওশনকে ‘চেয়ারম্যান’ ঘোষণা করায় প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি এবং ফখরুল ইমাম এমপিকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার কাদেরপন্থিদের যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এ পদক্ষেপকে অবৈধ বলেছেন রওশনপন্থিরা। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, জাপার টানাপড়েনে হস্তক্ষেপ করা হবে না।
দলে টানাপড়েন চললেও গতকালও দেখা মেলেনি জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর। জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে স্পিকারকে দেওয়া চিঠিতে জাপার ১৫ এমপি স্বাক্ষর করলেও গতকালের যৌথ সভায় রাঙ্গাঁসহ তিনজন গরহাজির ছিলেন। বাকি দু’জন বিদেশে বলে জানালেও, রাঙ্গাঁর খোঁজ জানতে পারেননি জাপার জ্যেষ্ঠ নেতারাও।
গতকাল জাপার বনানী কার্যালয়ে অনুসারীদের নিয়ে দিনভর বৈঠক করেন জিএম কাদের। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী বাছাইয়ে পার্লামেন্টারি বোর্ড মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেয়। তিনজন সাক্ষাৎকার দিলেও আসেননি এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহি সাদ। জিএম কাদের পক্ষের খবর, মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন রংপুর মহানগর জাপার সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির। দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনলেও সাদ কেন সাক্ষাৎকার দিতে আসেননি- তা জানা যায়নি।
আগামীকাল রোববার গুলশানের বাসভবনে পাল্টা ‘পার্লামেন্টারি বোর্ড’-এর সভা এবং একই দিন বিকেলে জাপার সংসদীয় দলের সভা ডেকেছেন বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ। তবে এ সভা আহ্বানকে অবৈধ বলেছেন জিএম কাদেরের অনুসারীরা। জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এমপিরা রওশনের ডাকা সভায় যাবেন না। ১৬ জন এমপি রওশনের সভায় যাচ্ছেন না বলে দাবি করেছেন কাদেরপন্থিরা। আরও তিন এমপি রাঙ্গাঁর মতো দু’পক্ষ থেকে দূরে রয়েছেন। রওশনের পক্ষে আছেন ছয়জন। গতকাল রওশন তার বাসায় অনুসারীদের নিয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। তবে তার পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি।
গত ১৪ জুলাই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর চার দিনের মাথায় জিএম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। রওশন তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। গত ৩১ আগস্ট এরশাদের চেহলামের পর দু’পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য বিরোধীদলীয় নেতার পদে বসতে চেয়ে স্পিকারকে চিঠি দেন জিএম কাদের। এ চিঠি আমলে না নিতে পাল্টা চিঠি দেন রওশন। গত বৃহস্পতিবার রওশনের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে তাকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতা দাবি করে দেবর-ভাবি পাল্টাপাল্টি চিঠি দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে।
জাপার প্রেসিডিয়ামের সদস্য সংখ্যা ৫১। এর মধ্যে আটজনকে এরশাদের মৃত্যুর পর নিয়োগ দিয়েছেন জিএম কাদের। জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গতকালের যৌথ সভায় দলের ২৫ এমপির ১২ জন এবং ২৮ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য উপস্থিত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রওশনের বাসায় সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য সোহেল রানা এদিন জিএম কাদেরের যৌথ সভায় যোগ দেন।
সভা সূত্র জানিয়েছেন, রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং ফখরুল ইমামকে বহিস্কারের দাবি তোলা হয়। তাদের দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সভা সূত্র। আজ শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না রওশন এরশাদের বিরুদ্ধে। সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া তার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।
সভার বিরতিতে ব্রিফ করেন দুই জ্যেষ্ঠ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। ফিরোজ রশীদ বলেন, দলের গঠনতন্ত্রের ২০ (১ক) ধারা অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান তার নিজ পদে যে কাউকে স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন। এই ক্ষমতাবলেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার জীবদ্দশায় জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন। তার মৃত্যুর পর জিএম কাদের জাপার চেয়ারম্যান হবেন বলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত দিয়ে যান।
রওশন এরশাদকে যারা জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন, তারা অবৈধ ও গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করছেন বলে দাবি করেছেন ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেছেন, জাপার গঠনতন্ত্রের ২২ ধারা অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান সংসদীয় দলের আস্থাভাজন কাউকে দলনেতা মনোনয়ন দিতে পারেন। এ ক্ষমতাবলে জিএম কাদের বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছেন। গত ১৭ আগস্ট প্রেসিডিয়ামের সভায় উপস্থিত ৩৪ সদস্যের ২৬ জন বিরোধীদলীয় নেতার পদে তাকে সমর্থন দিয়েছেন।
জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেছেন, যারা রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন, তারা শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ও দীর্ঘদিন ধরে দলে রয়েছেন। তারা ভুল বুঝতে পারবেন বলে আশা করেছেন তিনি।
জাপা মহাসচিবের অনুপস্থিতি সম্পর্কে জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, জিএম কাদেরকে সমর্থনকারী ১৫ এমপির প্রথম সইটি রাঙ্গাঁর। জিএম কাদেরকে গত ১৮ জুলাই চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন রাঙ্গাঁ।
রাঙ্গাঁ পক্ষে থাকলে টানা তিন দিন কেন দলীয় কার্যালয়ে অনুপস্থিত- এ প্রশ্নে ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘এর জবাব মহাসচিবই দিতে পারবেন।’ দু’পক্ষই দাবি করছে রাঙ্গাঁ তাদের পক্ষে রয়েছেন। জাপার সূত্রের খবর, গতকাল জিএম কাদের টেলিফোন করেও পাননি রাঙ্গাঁকে।
জাপা সূত্র জানিয়েছে, এরশাদ নিজেই রাঙ্গাঁকে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। কিন্তু জিএম কাদের নিজের হাতে এ ক্ষমতা নিতে ইসিকে চিঠি দেওয়ায় রাঙ্গাঁর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জাপার একজন যুগ্ম মহাসচিব জানিয়েছেন, রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ ছেড়ে দিতে এখনও প্রস্তুত রয়েছেন জিএম কাদের। কিন্তু তাকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিতে হবে রওশন এরশাদকে। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও ফখরুল ইমামকে শাস্তি দিতে হবে।
শাস্তির হুমকিতে বিচলিত নন বলে জানিয়েছেন ফখরুল ইমাম। তিনি বলেছেন, জিএম কাদের জাপার বৈধ চেয়ারম্যান নন। তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেগুলোও বৈধ নয়। গতকাল রওশনের বাসায় যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমামসহ কয়েক নেতা। রওশনের বাসভবন সূত্র জানিয়েছে, দলে চলমান বিরোধ ফয়সালায় তারা সরকারের সঙ্গে দেনদরবারের পথে যেতে চান।
গতকাল বিকেলে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাপার টানাপড়েন তাদের নিজস্ব ব্যাপার, আওয়ামী লীগের কিছু নয়। নিয়ম অনুযায়ী স্পিকারই বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন করবেন।