রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব ভবন। নির্মাণাধীন ওই ভবনের ভেতরে রড, সিমেন্ট, এসি, টাইলস, বাথরুম ফিটিংসসহ পড়ে আছে নানা ধরনের সামগ্রী। গতকাল সকালে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিশাল ভবনে সুনসান নীরবতা। গোটা এলাকায় শ্রমিক নেই একজনও। বন্ধ রয়েছে নির্মাণকাজ। ভবনের নিরাপত্তা রক্ষী মো. কাঞ্চন জানান, ৭-৮ দিন ধরে রাজস্ব ভবনের নির্মাণকাজ পুরোপুরি বন্ধ। অনিশ্চয়তার কারণে ঠিকাদার ও নির্মাণ শ্রমিকরা আসছেন না। সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, শুধু জাতীয় রাজস্ব ভবন নয়, জি কে শামীমের মালিকানাধীন জি কে বিল্ডার্সের অন্তত ১৭টি প্রজেক্টের সব কাজ আটকে গেছে। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে অধিকাংশ কাজই সরকারি নানা স্থাপনার।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেন বলেন, ‘শামীমের অনুপস্থিতিতে অন্য কেউ তার ঠিকাদারি কাজ এগিয়ে নিতে পারে কি-না সেটা আমরা দেখছি। সেটা না পারলে নিয়ম অনুযায়ী শোকজ করা হবে। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
সাহাদাত হোসেন আরও বলেন, ব্যাংক হিসাব নম্বর খুলে দিতে শামীমের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক হিসাব তো আমরা বন্ধ করিনি।
ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতনের অফিস থেকে গ্রেফতার হন জি কে শামীম। এরপর শামীম ও তার স্ত্রীর সব ব্যাংক হিসাব নম্বর জব্দ করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে একাধিক দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ-র্যাব। এতে বেরিয়ে আসে মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়ে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। গণপূর্তের দুই প্রকৌশলীকেই কমিশন বাবদ দিয়েছেন দেড় হাজার কোটি টাকা। শামীম ধরা পড়ার পর তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্মিত প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব প্রজেক্টের কাজ সম্পন্ন হওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা শঙ্কা। এমন বাস্তবতায় শামীমকে এককভাবে দেওয়া এসব সরকারি কাজ ‘গলার কাঁটা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্মিতব্য জাতীয় রাজস্ব ভবনের নিরাপত্তা রক্ষী মো. কাঞ্চন জানান, প্রতিদিন ইট-পাথরের টুংটাং শব্দে এলাকা সরগরম ছিল। মালিক নেই, এখন তাই কাজও বন্ধ।
জি কে বিল্ডার্সের সাইট ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘দিনে ৩০০-৪০০ জন শ্রমিক জাতীয় রাজস্ব ভবন নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দিনে মজুরি বাবদ অন্তত ১৫ লাখ টাকা দেওয়া লাগত। এখন কোন জায়গা থেকে টাকা আসবে। শ্রমিকদের টাকা দিতে না পারলে তারা কেন কাজে আসবে? এমন বাস্তবতায় সব কিছু বন্ধ হয়ে আছে।’
জি কে বিল্ডার্সের সাইট ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে রাজস্ব ভবন কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। সেভাবে সব কিছু এগিয়ে চলছিল। এখন সেই সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্মিতব্য জাতীয় রাজস্ব ভবনের পাশে একাধিক চায়ের দোকানে হাজার হাজার টাকা বাকি পড়ে আছে। বাদল নামে এক চা দোকানি শ্রমিকদের কাছে ১ লাখ টাকা পাবেন। কাজ বন্ধ থাকায় তার পাওনা টাকা উদ্ধারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এছাড়া শ্রমিকরা জি কে বিল্ডার্সের কাছে হাজার হাজার টাকা পাবেন। শামীম গ্রেফতারের পর চার দিন শত শত শ্রমিক কাজ চালিয়ে গেছেন। তবে ওই চার দিনের মজুরি তারা পাননি। পরে আর কাজে যোগ দেননি শ্রমিকরা।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জি কে শামীম তার ঠিকাদারি কাজের আর্থিক বিষয়গুলো একাই দেখভাল করতেন। বেশ কিছু চেক তার সহকর্মীদের তিনি দেন। তবে ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকায় এসব চেক দিয়ে টাকা তোলা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জি কে শামীমের স্ত্রী একটি সরকারি কলেজের শিক্ষক। তাই আপাতত সরকারি কর্মচারী হয়ে শামীমের ব্যবসার দায়িত্ব নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
সংশ্নিষ্টরা জানান, উত্তরার আশকোনায় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকায় র্যাব সদর দপ্তর, ১৩ কোটি টাকায় পোড়াবাড়ীতে র্যাব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৫০০ কোটি টাকায় আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবন, ১৫০ কোটি টাকায় আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালের নতুন ভবন, ৫০ কোটি টাকায় এনজিও ভবন, ১৫০ কোটি টাকায় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, ১২ কোটি টাকায় পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ৩০ কোটি টাকায় বিজ্ঞান জাদুঘর, ১৫০ কোটি টাকায় সচিবালয়ের সম্প্রসারিত ভবন, ১০ কোটি টাকায় বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির, ১৫০ কোটি টাকায় হিলট্র্যাক্টস ভবন ও ১৫০ কোটি টাকায় মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শামীমের প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, ল্যাবরেটরি মেডিসিন ভবন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কেবিনেট ভবন নির্মাণসহ বেশ কিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে গণপূর্তের অসাধু কর্মকর্তাসহ একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে ‘ঠিকাদার মোগলে’ পরিণত হন জি কে শামীম। তার ভয়ে অনেক ঠিকাদার দরপত্র কিনতে সাহস পেতেন না। আবার গণপূর্তের কর্মকর্তারা মোটা কমিশনে শামীমকে কাজ দিতে নানা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে এরই মধ্যে অনেক তথ্য দিয়েছেন শামীম। ঢাকার বাসাবো ও নিকেতনে তার অন্তত ৫টি বাড়ি রয়েছে। রাজধানীতে একাধিক আলিশান ফ্ল্যাট আছে। গ্রামের বাড়ি সোনারগাঁয় বাড়ি রয়েছে তার। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ এক নেতাকে ‘সন্তুষ্ট’ রাখতে নিয়মিত মোটা অঙ্কের কমিশন দিতে হতো তাকে।