‘আজকে মিলনায়তন পরিপূর্ণ। এমন দর্শক প্রতিদিন এলে আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না!’ জাতীয় নাট্যশালায় বক্তৃতা দিতে এসে দর্শকের দিকে তাকিয়ে বললেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক নাট্যব্যক্তিত্ব মেঘনাদ ভট্টাচার্যও মুগ্ধ। তিনি বললেন, ‘আমি দেশে ফিরে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীদের বলব, এ রকম একটি বিরল উৎসব বাংলাদেশে হয়। যেখানে সাড়ে তিন হাজার সংস্কৃতিকর্মী অংশ নেন। এখানে না এলে আমি বুঝতে পারতাম না এ উৎসবের আভিজাত্য, মর্যাদা, বৈভব।’
যাঁরা গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ছিলেন না, তাঁরা বুঝে নিন গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের উদ্বোধনী দিনের চিত্রটা কেমন ছিল।
শুক্রবার বক্তৃতা এবং মঞ্চে প্রদীপ জ্বালানোর আগেই ভূপেন হাজারিকার ‘মঙ্গল হোক এই শতাব্দী মঙ্গল সবার’ গানের সঙ্গে স্পন্দনের নৃত্যশিল্পীরা দলীয় নৃত্য প্রদর্শন করেন। মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে উদ্বোধনী পর্বে বক্তৃতা দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী, ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক নিপা চৌধুরী, জাতীয় পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল কামাল বায়েজীদ। আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন পর্ষদের সদস্যসচিব আকতারুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন উৎসবের আহ্বায়ক গোলাম কুদ্দুছ।আসাদুজ্জামান নূর সংস্কৃতিচর্চাকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর মতে, ‘এটা হচ্ছে না বলেই আজ বুয়েটে মেধাবী ছাত্ররা আরেক মেধাবী ছাত্রকে মেরে ফেলছে। দেশে ক্যাসিনো-সংস্কৃতি চালু হয়েছে।’
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের মন্তব্য, এ উৎসব বাংলাদেশ-ভারতের ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব ও প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিবেশীর ভালোবাসার প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন ভারতের সম্পদ, তেমনি আমাদের বাংলাদেশেরও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছেন, তেমনি জাতীয় কবি হিসেবে বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত হয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতি হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ। এ অভিন্ন সাংস্কৃতিক বন্ধন প্রতিবেশী দুই দেশের মানুষকে পরস্পর আরও নিকটতর করেছে; পারস্পরিক ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতিকে আরও সমুন্নত করেছে।’
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে প্রাঙ্গণেমোর মঞ্চস্থ করে ‘হাছনজানের রাজা’। শাকুর মজিদের রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন অনন্ত হিরা। পরীক্ষণ থিয়েটার হলে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চস্থ করে রোজী সিদ্দিকীর একক অভিনয়ের নাটক ‘পঞ্চনারী আখ্যান’। হারুন রশীদের রচনায় যার নির্দেশনা দিয়েছেন শহীদুজ্জামান সেলিম। স্টুডিও থিয়েটার হলে পালাকার মঞ্চস্থ করে নাটক ‘উজানে মৃত্যু’। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনা অবলম্বনে যার নির্দেশনা দিয়েছেন শামীম সাগর। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে লোক নাট্যদল (বনানী) মঞ্চস্থ করে ‘কঞ্জুস’। মলিয়েরের ‘দ্য মাইজার’ অবলম্বনে নাটকটি রূপান্তর করেছেন তারিক আনাম খান এবং নির্দেশনা দিয়েছেন কামরুন নূর চৌধুরী।
আজ শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তন এবং জাতীয় নাট্যশালার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ছিল সাংস্কৃতিক নানা পরিবেশনার আয়োজন। সন্ধ্যা সাতটায় জাতীয় নাট্যশালায় ভারতের দল সায়কের নাটক ‘দায়বদ্ধ’, পরীক্ষণ থিয়েটারে নাট্যতীর্থের ‘কঙ্কাল’ এবং স্টুডিও থিয়েটারে প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের ‘প্রাচ্য’ মঞ্চস্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি মিলনায়তনে থিয়েটার আর্ট ইউনিট পরিবেশন করবে ‘গোলাপজান’।আগামীকাল রোববার মঞ্চস্থ হবে জাতীয় নাট্যশালায় নাগরিক নাট্যাঙ্গন বাংলাদেশের ‘গহর বাদশা ও বানেছা পরী’, পরীক্ষণ থিয়েটারে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের ‘নীলাখ্যান’ এবং স্টুডিও থিয়েটারে বাংলা নাট্যদলের ‘মেঘ’ মঞ্চস্থ হবে। ১৪ অক্টোবর সোমবার লোক নাট্যদল (সিদ্ধেশ্বরী) মঞ্চস্থ করবে নতুন নাটক ‘আমরা তিনজন’, সুবচন নাট্যসংসদ ‘মহাজনের নাও’ এবং বাতিঘরের নাটক ‘রেড ক্লিফ’। ১৫ অক্টোবর মঙ্গলবার প্রদর্শনীতে থাকবে থিয়েটারের সাড়া জাগানো নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, আরশিনগর ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ এবং ঢাকা নান্দনিকের নাটক ‘নড়বড়ে বউ’। ১৬ অক্টোবর বুধবার প্রদর্শনীতে থাকবে ভারতের নাট্যদল অনীকের নাটক ‘পিরানদেল্লো ও পাপেটিয়ার’, ঢাকা পদাতিকের ‘কথা ৭১’ এবং একটি নির্মল ‘যাত্রাপালা’। ১৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার আসরে থাকবে চট্টগ্রামের স্বনামধন্য নাট্যদল তির্যকের আলোচিত নাটক ‘ইডিপাস’, চন্দ্রকলা থিয়েটারের ‘শেখ সাদি’ এবং জগরণী থিয়েটারের ‘রাজার চিঠি’। ১৮ অক্টোবর শুক্রবার ছুটির দিনে মঞ্চে থাকবে ভারতের দল বেলঘরিয়া অভিমুখের নাটক ‘কোজাগরী’, দর্শনার দল অনির্বাণ থিয়েটারের ‘জিষ্ণুযারা’ এবং নাট্যম বরিশালের ‘তিলক’। পরদিন ১৯ অক্টোবর শনিবার মঞ্চে থাকবে নাট্যচক্রের ‘ভদ্দরনোক’, ভারতের নাট্যদল বেলঘরিয়া রূপ তাপসের ‘এলা এখন’ এবং নাট্য রেপার্টরির ‘ডিয়ার লায়ার’।
২০ অক্টোবর সমাপনী দিনে আরণ্যক নাট্যদল মঞ্চস্থ করবে দলের আলোচিত নাটক ‘ময়ূর সিংহাসন’, সময় মঞ্চস্থ করবে ‘ভাগের মানুষ’ এবং থিয়েটার ৫২ মঞ্চস্থ করবে ‘নন্দনপুরের মেলায় একজন কমলা সুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’।
অষ্টমবারের মতো এবারও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশগ্রহণে এই সাংস্কৃতিক যজ্ঞ। এবার গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি মিলনায়তন, মুক্তমঞ্চ এবং বাংলাদেশ মহিলা সমিতি মিলনায়তন। এসব স্থানে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে চারটা থেকে থাকবে নানা বিষয়–বৈচিত্র্যের পথনাটক, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্যসহ নানা পরিবেশনা।
এবার উৎসবে মঞ্চনাটক নিয়ে ভারতের চারটি নাট্যদল এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ২৬টি নাট্যদলসহ মোট ৩০টি নাটকের দল অংশ নেবে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার অভিন্ন সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং সংস্কৃতির মানুষের মৈত্রীর বন্ধন আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্য নিয়েই সাত বছর ধরে ‘গঙ্গা-যমুনা উৎসব’-এর আয়োজন করে যাচ্ছে গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব উদ্যাপন কমিটি।
কয়েক বছর ধরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসব’। আসরটি দুই বাংলার থিয়েটার অঙ্গনে সাড়া ফেলে। শুরু থেকেই কলকাতার এই নাট্যোৎসবে বাংলাদেশের একাধিক নাট্যসংগঠন অংশ নিয়ে আসছে। ২০১২ সাল থেকে একই নামে বাংলাদেশেও একটি উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করে ‘গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসব’ পর্ষদ। ২০১৪ সালে এসে নাট্য প্রদর্শনীর পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মেলবন্ধনে উৎসবকে আরও প্রসারিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরই আলোকে নামকরণ করা হয় ‘গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব’।