মা-বাবা দুজনেই অর্থনীতির স্বনামধন্য অধ্যাপক। তাঁদের ছেলেও অর্থনীতির শিক্ষক। বাবা-মার কর্মজীবন কেটেছে কলকাতাতেই। কিন্তু ছেলে এখন মার্কিন মুল্লুকের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক। আর আজ সোমবার এই বঙ্গসন্তানের প্রাপ্তির মুকুটে যুক্ত হলো নোবেল। যাঁর কথা বলা হচ্ছে, তাঁর পুরো নাম অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
অর্থনীতিতে এ বছর তিন নোবেল বিজয়ীর একজন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন অর্থনীতিবিদ। বাঙালিও পেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন ও ড. মুহম্মদ ইউনুসের পর আরেক নোবেলজয়ী। কলকাতায় জন্ম নেওয়া অভিজিৎ শুধু একাই নন, তাঁর স্ত্রী ফরাসি বংশোদ্ভূত মার্কিন অর্থনীতিবিদ এস্তার দুফলোও এবার নোবেল পেয়েছেন।
অভিজিতের জন্ম মুম্বাইয়ে ১৯৬১ সালে। এমআইটির শিক্ষকতার পাশাপাশি একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত অভিজিৎ। তিন আব্দুল লতিফ জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাবের সহ প্রতিষ্ঠাতা। ইনোভেশন ফর পোভার্টি অ্যাকশনের গবেষক। তিনি কনসোর্টিয়াম অন ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমস অ্যান্ড পোভার্টির সদস্য।
মা নির্মলা ব্যানার্জি ও বাবা দীপক ব্যানার্জির সন্তান অভিজিৎ। তাঁর মা নির্মলা কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেসের অর্থনীতির অধ্যাপক। বাবা দীপক ব্যানার্জি কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন।
অভিজিতের শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলকাতাতেই। কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। পরে পড়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতেও কেটেছে শিক্ষাজীবনের একটি অংশ। এরপর ১৯৮৮ সালে তিনি হাভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন।
সুইডিশ রয়্যাল একাডেমি অর্থনীতিতে নোবেলের জন্য এই তিনজনের নাম ঘোষণা দিয়ে বলেছে, ‘বৈশ্বিক দারিদ্র্য নিরসনে এই ত্রয়ী আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। মাত্র দুই দশকে তাদের পরীক্ষামূলক গবেষণা উন্নয়ন অর্থনীতির মোড় পরিবর্তনে সহায়তা করেছে। এটা গবেষণার একটি নতুন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।’
একাডেমি আরও বলেছে, এই তিনজনের পরীক্ষামূলক গবেষণা পদ্ধতি ৫০ লাখের বেশি ভারতীয় শিশুকে উপকৃত করেছে।
অভিজিৎ ব্যানার্জির প্রথম স্ত্রী অরুন্ধতী তুলি ব্যানার্জি এমআইটির প্রভাষক। তিনিও কলকাতাতেই বেড়ে ওঠেন। কবির ব্যানার্জি নামে দুজনের একটি ছেলেও ছিল। পরে অভিজিৎ-অরুন্ধতীর বিচ্ছেদ হয়। ২০১৬ সালে মারা যান এ দম্পতির ছেলে কবির। গবেষণার সঙ্গী এস্তার দুফলো ২০১৫ সালে অভিজিতের জীবনসঙ্গী হন।
বিশ্বের নামী সব সাময়িকীতে অসংখ্য লেখা প্রকাশ হয়েছে অভিজিৎ ব্যানার্জির। বই আছে নিজের লেখা চারটি। এর মধ্যে অভিজিৎ ও এস্তারের লেখা ‘পুওর ইকনোমিকস’ বইটি জিতেছে গোল্ডম্যান স্যাকস বিজনেস বুক অব দ্য ইয়ার পুরস্কার।
অভিজিতের নোবেল পাওয়ার খবরে উদ্বেল ভারতের বিদ্বৎ সমাজ। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধীর’ লেখক রামচন্দ্র গুহ টুইটারে লিখেছেন, ‘লেখাপড়ায় অসামান্য তিনি। এর পাশাপাশি হাতের রান্নাও দারুণ। আর ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের একনিষ্ঠ ভক্ত তিনি। ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বোত্তম দিকগুলোই তিনি তুলে ধরেন।’
অভিজিতের নোবেল জয়ে আনন্দিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টুইট বার্তায় মমতা লিখেছেন , ‘নোবেল জয়ে সাউথ পয়েন্ট স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজের সাবেক এই শিক্ষার্থীকে হৃদয় নিংড়ানো অভিনন্দন জানাই। আরেক বাঙালি জাতিকে আবার গর্বিত করল। আমরা আপ্লুত।’
১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন অমর্ত্য সেন। এবার পেলেন অভিজিৎ। তাঁর পুরো নাম অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। অমর্ত্য সেনেরই ছাত্র অভিজিৎ।
একসঙ্গে নোবেল জিতেছেন যে দম্পতিরা
তালিকায় নবতম সংযোজন হিসেবে আজ যুক্ত হয়েছেন অভিজিৎ-দুফলো দম্পতি। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) সহকর্মী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করার পর ২০১৫ সালে বিয়ে করেন অভিজিৎ ও দুফলো। এর আগে এমআইটিরই আরেক অধ্যাপক অরুন্ধতী তুলি ব্যানার্জিকে বিয়ে করেছিলেন অভিজিৎ। অরুন্ধতীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর দুফলোর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন অভিজিৎ। বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণে পরীক্ষামূলক গবেষণার জন্য ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল জিতলেন এই দম্পতি।
এই পাঁচটির বাইরে কিন্তু আরও একটি নোবেলজয়ী দম্পতি আছে। এই দম্পতি হলো, আলভা মিরডাল-গানার মিরডাল দম্পতি। ওপরের পাঁচ দম্পতির সঙ্গে এই দম্পতির মূল পার্থক্য হলো, এখন পর্যন্ত একমাত্র দম্পতি হিসেবে আলাদা আলাদাভাবে এবং ভিন্ন বিভাগে নোবেল জিতেছেন আলভা-গানার দম্পতি। ১৯৭৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল জেতেন গানার। আর ১৯৮২ সালে শান্তিতে নোবেল জেতেন আলভা।
২০১৯ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করেছে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস। চতুর্থ বাঙালি হিসেবে এবার নোবেল জিতেছেন ভারতের কলকাতায় জন্ম নেওয়া অভিজিৎ ব্যানার্জি। তবে শুধু অভিজিৎ নন, একই সঙ্গে এ বছর নোবেল জিতেছেন তাঁর স্ত্রী এস্তার দুফলোও। স্বামী-স্ত্রীর একই সঙ্গে নোবেলজয়ের ঘটনা ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায়নি। এই নিয়ে মাত্র পঞ্চম দম্পতি হিসেবে একই বছরে একই বিভাগে নোবেল পেলেন অভিজিৎ-দুফলো দম্পতি। অভিজিৎ-দুফলোর সৌজন্যে অন্য চার নোবেল বিজয়ী দম্পতির গল্পও শুনে নেওয়া যাক।
মেরি কুরি-পিয়েরে কুরি
প্রথম ব্যক্তি হিসেবে দ্বিতীয়বার নোবেল জিতে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছিলেন মেরি কুরি। অন্য এক দিক থেকেও কিন্তু নিজের নাম অমর করে রেখেছেন তিনি। মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরিই প্রথম দম্পতি, যাঁরা একই বছর একই বিভাগে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। ১৯০৩ সালে স্বামী পিয়েরে কুরির সঙ্গে মিলে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জেতেন তিনি। শুরুতে অবশ্য মেরি কুরির নাম ওই বছরের নোবেলজয়ীদের তালিকায় ছিল না। কিন্তু স্বামী পিয়েরে কুরির আপত্তির পর পর্যালোচনা করে মেরিকেও নোবেল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আইরিন কুরি-ফ্রেডেরিক কুরি
মেরি কুরি-পিয়েরে কুরি দম্পতির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন তাঁদের পরিবারেরই অন্য দুই সদস্য। ১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল জেতেন মেরি-পিয়েরে দম্পতির বড় মেয়ে আইরিন কুরি ও তাঁর স্বামী ফ্রেডেরিক কুরি। মা-বাবার প্রতিষ্ঠিত রেডিয়াম ইনস্টিটিউটেই নিজের গবেষণাকাজ শুরু করেন আইরিন। ১৯২৪ সালে মেরি কুরির সহায়ক হিসেবে সেখানে যোগ দেন ফ্রেডেরিক। আইরিনের হাত ধরেই তেজস্ক্রিয়তা–সংক্রান্ত গবেষণায় হাতেখড়ি হয় ফ্রেডেরিকের। ১৯২৬ সালে বিয়ে করেন আইরিন ও ফ্রেডেরিক। এর নয় বছর পর ১৯৩৫ সালে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য রসায়নে নোবেল জেতেন এই দম্পতি।
গার্টি সোরি-কার্ল সোরি
গার্টি ও কার্লের পথচলার শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। একসঙ্গে মেডিকেল কলেজে পড়েছেন, পাস করেছেন, এরপর নোবেলটাও পেয়েছেন একই সঙ্গে। অস্ট্রিয়ায় জন্ম নেওয়া এই দুই বিজ্ঞানী তাঁদের গবেষণার বেশির ভাগটাই করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রায় ৩০ বছরের নিরলস গবেষণার পর ১৯৪৭ সালে গ্লুকোজ ও গ্লাইকোজেনের বিপাক ক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল জেতেন গার্টি-কার্ল দম্পতি।