দেশের ক্রিকেটে গত তিন দিন ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। বুধবার রাতে বিসিবি কর্মকর্তা ও ক্রিকেটারদের দুই ঘণ্টার আলোচনায় তা কেটে গেছে। সব দাবি মেনে নেওয়ায় শনিবার থেকে মাঠে ফিরছেন ক্রিকেটাররা। জাতীয় ক্রিকেট লিগের ম্যাচ তো খেলবেনই; ভারত সফরের ক্যাম্পেও যোগ দেবেন তারা। বুধবার দুপুরেও ভারত সফর নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলা বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন, ফলপ্রসূ আলোচনা শেষে স্বস্তির বার্তা দেন। সাকিব আল হাসানকে পাশে নিয়ে সংবাদ ব্রিফিংও করেন তিনি। এতে করে ক্রিকেটের জয় দেখতে পেল দেশের মানুষ। ব্রিফিংয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন পাপন। সাকিব ঘোষণা দেন, সব ধরনের ক্রিকেটীয় কর্মকাণ্ডে ফেরার। ক্রিকেটারদের এ জয় ১৬ কোটি মানুষেরও বিজয়। কারণ, ক্রিকেট এবং ক্রিকেটাররা দেশের মানুষের আবেগের জায়গা।
প্রথমে ব্রিফিং দেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তিনি জানান, একটু রাগ হয়েছিল, খেলোয়াড়দের কথা শোনার পর কোনো রাগ নেই তার। ক্রিকেটারদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করবেন না বলেও জানান তিনি। প্রতিটি বিভাগে একসঙ্গে ক্রিকেট অবকাঠামো গড়ে তোলার কথাও বলেন বিসিবিপ্রধান। সভাপতির কথায় আশ্বস্ত হয়ে টাইগার অধিনায়ক সাকিব আল হাসান জানান, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
১৩টি দাবি নিয়ে মিরপুরে বিসিবি কার্যালয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে নাজমুল হাসান পাপনসহ বিসিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ক্রিকেটাররা। এই দাবিগুলো আইনজীবীর মাধ্যমে বিকেলেই বিসিবির কাছে পাঠান তারা। ক্রিকেটারদের প্রথম দাবি ছিল ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)-এর কর্মকর্তাদের পদত্যাগ-সংক্রান্ত। কোয়াবের কমিটি ভেঙে দেওয়ার এখতিয়ার বিসিবির না থাকায় এটা নিয়ে আলোচনা হয়নি। বাকিগুলোর মধ্য থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেওয়া হয় ৯টি দাবি। এ বিষয়ে পাপন বলেন, ‘ওরা এসেছে, ওদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ওদের বেশ কিছু দাবি-দাওয়া ছিল আমি গতকালই (মঙ্গলবার) বলেছিলাম বেশির ভাগই মানার মতো। ওরা এলেই হয়ে যাবে। আজ তাই হয়েছে।’
সোমবার ১১ দফা দাবি জানিয়ে ধর্মঘট ডাকেন ক্রিকেটাররা। বুধবার আরও দুটি দাবি যোগ করেন তারা। লভ্যাংশ ভাগাভাগি আর পুরুষদের মতো নারী ক্রিকেটারদেরও সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার দাবি উত্থাপন করা হয়। আলোচনায় এ দুটি দাবি তোলা হয়নি বলে জানান বিসিবি সভাপতি। এছাড়া দুটির বেশি বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার বিষয়টিও অমীমাংসিত রয়েছে। এগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন পাপন- ‘আমাদের জানা মতে বেশি খেলোয়াড় নেই, যারা দুটির বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলে। যদি এমন হয় আমরা তখন কেইস টু কেইস দেখব।’ বিসিবি সভাপতি আরও জানান, ক্রিকেটারদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় লিগের তৃতীয় রাউন্ডের খেলা নতুন করে হবে।
তবে বিসিবি সভাপতির বক্তব্যের পর সাকিব বেশি কিছু বলতে চাননি। কোনো প্রশ্ন না করার অনুরোধ জানান সাংবাদিকদের। সাকিব শুধু এটুকুই বলেছেন, ‘পাপন ভাই তো বলেই দিয়েছেন যে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। আমাদের যে দাবিগুলো ছিল বোর্ড সভাপতিসহ পরিচালকরা সবাই শুনেছেন এবং আশ্বাস দিয়েছেন যত দ্রুততর সময়ে হওয়া সম্ভব সেটা তারা করবেন। সেই আশ্বাসের ভিত্তিতেই জাতীয় লিগের প্লেয়াররা আগামী শনিবার থেকে জাতীয় লিগ শুরু করছি এবং জাতীয় দলের প্লেয়াররা ২৫ অক্টোবর থেকে ক্যাম্প শুরু করছি।’
এর আগে দেশের ক্রিকেটের সংকট নিরসনে দিনভর নানা দৌড়ঝাঁপের পর বুধবার দুপুরেই সব দাবি মেনে নিতে রাজি থাকার কথা জানান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে বিসিবি সভাপতি ও কয়েকজন পরিচালক এদিন দুপুর থেকেই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু খেলোয়াড়রা শুরুতে সাড়া দেননি। বিকেলে ব্যারিস্টারের মাধ্যমে ১৩ দফা দাবি-দাওয়া বিসিবি কার্যালয়ে পাঠান তারা। সন্ধ্যায় ঢাকার গুলশানের একটি হোটেলে ক্রিকেটারদের উপস্থিতিতে ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খানের মাধ্যমে দাবিগুলো এবং আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। সেখান থেকে রাত ৯টার দিকে বিসিবি কার্যালয়ে যান খেলোয়াড়রা।
ধর্মঘটের ডাক দিলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিলেন বিসিবি সভাপতি পাপন। বিসিবি দাবি-দাওয়া মানতে রাজি থাকলেও ক্রিকেটাররা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। মঙ্গলবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান পাপন। একই সঙ্গে ক্রিকেটারদের আলোচনার টেবিলে আসার আহ্বানও জানান তিনি। তবে বুধবার একটা সমাধানে পৌঁছাতে ক্রিকেটাররাও উদ্যোগী হন।
কোথা থেকে, কোন খাত থেকে কত আয় হয়; কীভাবে ব্যয় করা হয় তার ব্যাখ্যা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি লভ্যাংশের ভাগ চাওয়া হয়েছে। এ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ক্রিকেটারদের পেনশন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। ক্রিকেটবিশ্বের খুব কম দেশেই এ নিয়ম চালু আছে। ভারত, পাকিস্তান বা শ্রীলংকায় লভ্যাংশ ভাগ দেওয়া হয় না। তবে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড তাদের খেলোয়াড়দের লভ্যাংশ দেওয়ার নিয়ম রেখেছে। এই খাত থেকে পাওয়া অর্থের একটা অংশ দেশটির ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারদের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে চান বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। সংবাদ সম্মেলনে খেলোয়াড়দের প্রতিনিধি বলেন, ‘খেলোয়াড়রা দাবি-দাওয়াগুলো দিয়েছিলেন মৌখিকভাবে মিডিয়ার মাধ্যমে। বিসিবিকে দিতে হলে গুছিয়ে লিখিত দিতে হতো। ক্রিকেটারদের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। এ জন্য লিখিত দাবি পেশ করতে আমাকে নিয়োগ দেন ক্রিকেটাররা। বিসিবিকে যে দাবিগুলো লিখিত আকারে দেওয়া হয়েছে, তা উকিল নোটিশ নয়। এখানে আইনি কিছু নেই। ক্রিকেটারদের ডিমান্ড নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যাতে করে সব পক্ষ সুবিধাজনক স্থানে থাকে।’
তবে বাংলাদেশের মতো ক্রিকেট খেলুড়ে দেশে লভ্যাংশ দেওয়ার ব্যাপারে খেলোয়াড়দের মধ্যেই কানাঘুষা আছে। কারণ, খোদ ভারতের মতো শীর্ষ ধনী ক্রিকেট বোর্ড তার লভ্যাংশের ভাগ ক্রিকেটারদের দেয় না। বাংলাদেশে সেটা দেওয়া কতটা বাস্তবসম্মত, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যদিও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ক্রিকেটারদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা রেখেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখনও তেমন কিছু চালু হয়নি। ক্রিকেটারদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ক্রিকেটাররা এ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন বলে জানান সাকিব।
ক্রিকেটারদের এ আন্দোলন এত দূর গড়ানোর পেছনে কর্মকর্তাদের দায় কম নয়। বিলম্ব না করে সোমবার সন্ধ্যায় সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে প্রাথমিকভাবে দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেই বিষয়টির সহজ সমাধান হতে পারত বলে মনে করে বিসিবির কর্মকর্তাদের একাংশ। উল্টো মঙ্গলবার বিসিবি সভাপতি পাপন সংবাদ সম্মেলনে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত আক্রমণ করায় পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (ফিকা) সমর্থন পেয়ে আন্দোলনরত ক্রিকেটাররা দাবি আদায়ে জোর পান।