শ্রমিক লীগের গঠনতন্ত্রে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনটিকে গত এক দশকে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়ে মাঠে নামতে দেখা যায়নি।
শিল্পায়নের ধরণ পরিবর্তন ও সরকার-মালিক আঁতাত বাড়ার কারণে শ্রমিক অধিকার সংকুচিত হওয়ার মধ্যেই এক দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় সংগঠনটি প্রায় নির্জীব হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন আন্দোলনে সক্রিয় শ্রমিক নেতারা।
তবে শ্রমিক লীগের নেতারা দাবি করছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘শ্রমিকবান্ধব’ হওয়ায় তারা দাবি-দাওয়া নিয়ে গেলেই তা পূরণ হয়ে যাচ্ছে বলে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার প্রয়োজন পড়ছে না।
শ্রমিক নেতা ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি শহিদ উল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, জাতীয় শ্রমিক লীগসহ সরকার সমর্থক সংগঠনগুলো শ্রমিকদের স্বার্থে মাঠে তো নামেই না উল্টো তাদের দলবাজির কারণে শ্রমিক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সিপিবির সাবেক সভাপতি বলেন, “এরা শ্রমিক আন্দোলনকে সর্বনাশ করেছে। পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলনে তারা নেই। পাটকল শ্রমিকদের পেটে ভাত নেই অথচ শ্রমিক লীগের নেতারা ঘুরে দামি গাড়ি দিয়ে।
“অথচ আজকে বেতন-বোনাস না পেয়ে ক্ষুধার্ত পাটকল শ্রমিকরা। শ্রমিক লীগের কেউ একবার তাদের খবরও নেয়নি। তাহলে তারা কীসের শ্রমিক সংগঠন? সরকারের স্বার্থ দেখতে গিয়ে তারা শ্রমিক আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টি করে।”
শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিক লীগের অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, এখন বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই শ্রমিক ইউনিয়ন নেই, যার কারণে শ্রমিকরা অসংগঠিত। ইচ্ছা করলেই তাদের নিয়ে মাঠে নামা যায় না।
“তাছাড়া আমরা শ্রমিকদের কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেই। আমরা বিভিন্ন সময় শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকবান্ধব সরকার প্রধান। তিনি শ্রমিকদের সব চাহিদা মিটিয়েছেন; প্রস্তাবেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে। রাস্তায় নেমে আন্দোলন না করে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছি।”
জাতীয় শ্রমিক লীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য শনিবার কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। বেলা ১১টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর বিকাল ৩টায় রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে নেতা নির্বাচনের জন্য অধিবেশন বসবে।
দুই বছর পর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও সাত বছর ধরে সংগঠনটির শীর্ষ দুটি পদ আঁকড়ে রয়েছেন শুকুর মাহমুদ ও সিরাজুল ইসলাম।
২০১২ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সভাপতি হন আগের কমিটির সহসভাপতি শুকুর মাহমুদ ও যুগ্ম সম্পাদক সিরাজুল।
সঠিক সময়ে সম্মেলন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ বলেন, “সময়মতো সম্মেলন না হওয়ার কারণে শ্রমিক লীগের নেতা-কর্মীদের মাঝে হতাশা বেড়েছে। এতে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসার পথ রুদ্ধ হচ্ছে।”
১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক লীগ বাকশাল গঠনের সময় একটি ভাঙনের পর ১৯৮৭ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থক সংগঠন হিসেবে জাতীয় শ্রমিক লীগ নামে চলছে। তার আগে শ্রমিক আন্দোলনে সংগঠনটির অনেক ভূমিকা ছিল।
এবারের কাউন্সিলের মাধ্যমে ‘স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি’ আছে এমন নেতারা নেতৃত্বে এলে শ্রমিক লীগ ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন শ্রমিক লীগের পুরনো সংগঠক বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেন, “আমরা চাই, কোনো দুর্নীতিবাজ ও অনুপ্রবেশকারী যাতে শ্রমিক লীগের নেতৃত্বে যাতে না আসে।”
তবে শ্রমিক লীগের মাঠে অনুপস্থিতির বিষয়ে একই সিরাজুলের সুরেই কথা বলেন হুমায়ুন, যিনি এই কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী।
তিনি বলেন, “শ্রমিকদের দাবি নিয়েই আমাদের কাজ। আন্দোলন সংগ্রাম আমরা করেছি। আমাদের সরকার ক্ষমতায় থাকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানালেই সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে, তাই আন্দোলনের দরকার হয় না।”
সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক বলেন, “সম্মেলনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সারা দেশ থেকে ৮ হাজার ১১৭ জন কাউন্সিলর সম্মেলনে উপস্থিত হবেন।”
শুক্কুর ও সিরাজুল- দুজনই নতুন কমিটিতে আবারও জায়গা পেতে চান।
এবার তাদের পাশাপাশি সহসভাপতি সরদার মোতাহের হোসেন, হাবিবুর রহমান আকন্দ, আমিনুল হক ফারুক ও এজাজ আহমেদের নাম সভাপতি প্রার্থী হিসেবে এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, সিরাজুল ইসলাম, তোফায়েল আহমেদ, শামসুল আলম মিলকী, কে এম আজম খসরু, দপ্তর সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, অর্থ সম্পাদক মো. সুলতান আহমেদ, শ্রমিক উন্নয়ন ও কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাউসার আহমেদ পলাশ, অর্থ বিষয়ক সম্পাদক সুলতান আহমেদের নাম সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছে।