দুর্নীতিতে দণ্ডিত খালেদা জিয়ার গৃহকর্মীসহ হাসপাতালে অবস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি তো ‘রাজার হালেই’ আছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে তার দলের নেতারা যে দাবি করছেন সে বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেছেন, “তার অসুস্থতা, সেটা তো পুরানো। ’৯১ সালে সরকারে এসে তার ‘নি’ (হাঁটু) রিপ্লেস করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সৌদি আরবে আবার অপারেশন করা হয়।
“বিদেশে যাওয়ার পরে সে যখন শপিং করে তখন হুইল চেয়ারে শপিং করত, ফালু ঠেলত, আর সে গিয়ে শপিং করত। সে যখন হজ করে সেখানেও ফালু হুইল চেয়ার ঠেলে সে হজ করে। হুইল চেয়ারে বসা সেটা নতুন কিছু হয়। এটাতো বহু যুগ ধরে দেখে আসছি।”
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া এতিমখানা মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি আছেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। প্রথম দিন থেকেই কারাগারে তার সঙ্গে আছেন দীর্ঘদিনের গৃহ পরিচারিকা ফাতেমা বেগম। এরমধ্যে অসুস্থ হওয়ায় গত আট মাস ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন খালেদা জিয়া।
সেখানে তার সুষ্ঠু চিকিৎসা হচ্ছে না অভিযোগ করে ৭৩ বছর বয়সী খালেদাকে ‘পঙ্গুত্ব’ থেকে রক্ষায় তার জামিনের দাবি জানাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে খালেদার জামিন শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কর্তৃপক্ষের কাছে খালেদার শারীরিক অবস্থার প্রতিবেদনও চেয়েছে আদালত।
এদিনই দলীয় চেয়ারপারসনের জামিন হবে বলে আশাবাদী বিএনপির একাধিক নেতা তা না হলে নেত্রীকে মুক্ত করতে আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন।
তার আগের দিন বুধবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে দলের জাতীয় কমিটির বৈঠকে বক্তব্যে এ বিষয়ে কথা বলেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “খালেদা জিয়া যে জেলে আছে, সে তো ভালো, রাজার হালেই আছে। জেলখানা থেকে এখন হাসপাতালে। তার জন্য আবার মেইড সার্ভেন্ট দেওয়া হয়েছে। মানুষ এমনিতে কাজের বুয়া পায় না। আর খালেদা জিয়ার জন্য স্বেচ্ছায় একজন কারাবরণ করছে, তার সেবা করার জন্য। এতটুকু সুবিধা তাকে দেওয়া হয়েছে।
“আমাদের ভিতরে কোনো প্রতিহিংসাপরায়ণতা নাই। কিন্তু পৃথিবীর কোন দেশে এই দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবেন, জেলে সাজাপ্রাপ্ত আসামির সেবার জন্য কোনো কাজের বুয়া যায়? সেটাও কিন্তু সে পাচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের একটা কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত রেখেছি। এই সন্ত্রাসের গডমাদারই হচ্ছে খালেদা জিয়া। সে এই বাংলা ভাই সৃষ্টি থেকে শুরু করে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরে ফেলা, এর চেয়ে বড় সন্ত্রাসী কাজ তো হয় না। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা, এর চেয়ে বড় সন্ত্রাসী কাজ আর কি হতে পারে? ঠাণ্ডা মাথায় হরতাল অবরোধ ডেকে, যে অবরোধ এখনও তিনি তোলেননি।”
স্বাধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাক, তা দেশি-বিদেশি স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনও চাননি এবং নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে এসেছে বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
“যে কারণে বাংলাদেশ যখনই সুষ্ঠুভাবে চলতে শুরু করেছে তখনই আসল ১৫ অগাস্ট। ১৫ অগাস্টে যে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন, সেটা খুনি রশিদ ও ফারুকের বক্তব্যেই প্রমাণিত।”
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশকে এগিয়ে নিতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেগুলো তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলাম, স্বাক্ষরতার হার, বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়েছিলাম, বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। আমরা প্রতিটি সেক্টরকে বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম। এতে আমাদের অর্থনীতির চাকা আরও সচল হয়। দুর্ভাগ্য হলো ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারি নাই। আমাদের আসতে দেওয়া হয়নি, সেটা একটা গভীর চক্রান্ত ছিল।
“২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পরে অমানবিক নির্যাতন শুরু করেছিল। এই নির্যাতনের শিকার শুধু আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী তা না, একদিনে ১৩ জন সচিবের চাকুরি নাই। শত শত সেনা অফিসার, সিভিল প্রাশসকদের চাকুরিচ্যুত করা হল। আর যাদের চাকুরিচ্যুত করা হয়নি তাদের ওএসডি করা হয়েছিল, যতদিন খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিল তারা ওএসডি ছিল। এভাবে তারা অত্যাচারের ‘স্টিম রোলার’ চালাতে থাকে।”
একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অভিযোগ খারিজ করে ওই ভোটে তাদের ভরাডুবির পেছনে ‘কী কারণ’ রয়েছে, তারও একটি ব্যাখ্যা দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
তিনি বলেন, “২০১৮ সালের নির্বাচন, যে নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বলতে চায় বিএনপি। এটা তারা ভুলে যায় যে এক-একটা সিটের পিছনে তারা দুই-তিনজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। যে যখন যার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে তাকেই মনোনয়ন দিচ্ছে। একভাগ দিতে হচ্ছে লন্ডনে আর দুইভাগ দিতে হচ্ছে বাংলাদেশে। গুলশানের অফিসকেও সন্তুষ্ট করতে হয়েছে, পুরানো পল্টনের অফিসকেও। যে টাকা দিতে পারছে না সে মনোনয়ন পাচ্ছে না।
“একজন মনোনয়নপত্র জমার দেওয়ার দুই-তিন ঘণ্টা পরে আরেকজন জমা দেয়। একটা সিটের জন্য দুই তিনজনে যারা মনোনয়ন দেয়, তারা নির্বাচনে জেতার জন্য না। মনে হয় এটাকে একটা বাণিজ্য হিসাবে নিয়েছিল তারা। আসলে আন্তর্জাতিকভাবে যে সার্ভেটা হয়েছিল তাতে সবাই দেখতে পেয়ছিল, যে বিএনপি সিট পাবে না, সেই জন্য নির্বাচনটাকে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য হিসাবে নিয়ে নেয়। সেখানে সিট না পেয়ে অন্যদের দোষারোপ দেওয়ার কোনো মানে হয় না।”
শেখ হাসিনা বলেন, “একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার পরেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এটাকে অনেকেই কিছু বলতে পারে। এই এটা করেছে, ও এনজিও করেছে, অনেকেই অনেক কিছু করেছেন, তার জন্য দেশের উন্নতি হয়েছে।
“তাই যদি হত তাহলে দারিদ্র্যের হার কমেনি কেন? প্রবৃদ্ধির হার বাড়েনি কেন? আর্থ-সামাজিক উন্নতি হয়নি কেন? একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই দেশের উন্নতি হয়েছে। আজকে আমরা ৮ দশমিক ১৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে।”
টকশো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেলিভিশন চ্যানেল বেশি হওয়ায় মানুষ ‘টক কথা বলার’ সুযোগ পাচ্ছে।
“এই যে এতগুলি টেলিভিশন, সেটা কে দিয়েছে? এত বেসরকারি খাত উন্মুক্ত করেছে, সেটা কে করেছে? এগুলো আমাদের সরকার করেছে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন তো করেনি। আমি যখনই প্রধানমন্ত্রী হয়েছি তখনই বেসরকারি টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দিয়েছি৷ এটা শুধু টেলিভিশন না, এর মাধ্যমে কত লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
“আর টক শোতে গিয়ে টক মিষ্টি কথা বলার কত মানুষ পাচ্ছে। টক টক কথাতো বলেই যাচ্ছে। এই দৃশ্যতো আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। এই যে মানুষের কথা বলার সুযোগ, এত কথা বলতে সুযোগ দেওয়ার পরেও, অত কথা বলা পরেও বলবে- এই সরকার আমলে আমাদের কথা বলার অধিকার নাই। বলে যাচ্ছে কিন্তু, তারপরেও পরচর্চা করবে। আসলে এই ধরনের পরচর্চা এক ধরনের অভ্যাস। এটা বড় কথা না যে আমরা দেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারা ‘অগ্নিসন্ত্রাসীরা’ যেন আর ক্ষমতায় আসতে না পারে সেই আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অনেক পরিকল্পনা আমরা নিয়েছি। ২০২১ সালের মধ্যে দেশ কোথায় নিয়ে যাব, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ উন্নত-সমৃদ্ধ হবে। ২১০০ সাল পর্যন্ত আমরা একটা ছক তৈরি করার পরিকল্পনা আমরা নিয়ে নিয়েছি। তারই ভিত্তিতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করব।
“আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে আমরা সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বিশ্বে চলতে পারি সেটা আমরা অর্জন করতে পেরেছি, সেটা ধরে রাখতে হবে। ঘুষখোর, সুদখোর, এতিমের অর্থ চুরি করা, মানিলন্ডারিং, গ্রেনেড হামলাকারী, বোমা হামলাকারী, আগুনে পুড়িয়ে মারা অগ্নিসন্ত্রাসী- এরা যেন এদেশে আর কোনো দিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না আসতে পারে, দেশকে ধ্বংসের দিকে নিতে না পারে জাতির কাছে সেটাই আমার আহ্বান।”