প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার-পরিজনকে ধৈর্য ধরে শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, রাজাকারের তালিকার যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে এবং সেখানে কোন মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি স্পষ্ট বলে দিতে চাই কোন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার খেতাব দেয়া হবে না, হতে পারে না। এটা অসম্ভব। অন্তত আমার সময় না। এটা কোনদিন আমরা হতে দেব না।’
তিনি বলেন, যারা রাজাকার তাদেরতো আলাদা গেজেট করাই আছে। কাজেই এই তালিকা কোনমতেই রাজাকারের তালিকা না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বরের কাউন্সিল উপলক্ষে আয়োজিত কার্যনির্বাহী সংসদের সভার সূচনা ভাষণে একথা বলেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবাযদুল কাদেরসহ সকল কার্যনির্বাহী সদস্য উপস্থিত ছিলেন। বাসস
শেখ হাসিনা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এটা চলে আসাতে (তালিকা প্রকাশ) খুব স্বাভাবিক একজন মানুষের কষ্ট লাগবে। যারা এত কষ্ট করলো, যাদের পরিবারের মানুষ শহীদ হলো, তারপর যারা মুক্তিযুদ্ধ করলো তাদেরকে যদি রাজাকার বলা হয়, এর চেয়ে দুঃখ ও কষ্টের আর কিছু থাকে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যাঁরা দুঃখ পেয়েছেন আমি তাদেরকে বলবো, যেন শান্ত হোন এবং ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখেন।’ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, ৪৯তম বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই তালিকার নাম নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে আজ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তালিকাটি স্থগিত করে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তা যাচাই-বাছাই করে প্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভুল বুঝাবুঝির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকারের সময় করে যাওয়া সন্ত্রাসীদের (বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা) তালিকা এবং পরবর্তী সময়ে তৈরি করা একটি কলাবরেটরদের তালিকা গণ্ডগোল পাকিয়ে এই নতুন রাজাকারের তালিকা তৈরি হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী একে রহস্যজনক আখ্যায়িত করে পাকিস্তান আমলের পুরনো তালিকা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগকে দমন-পীড়নের জন্য জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ব্যবহার করায় সেটি থেকে যায় বলেও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা অনেকেই জানেন একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধে যারা গিয়েছিল তাদের সকলের একটি তালিকা করে তাদেরকে সেখানে সন্ত্রাসী ও দুবৃর্ত্ত হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তান সরকার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়।’
তিনি বলেন, ‘এই তালিকা পাকিস্তান সামরিক শাসকদের তৈরি করা তালিকা। এটা নিয়ে গোলমাল হোত না যদি এটা জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ব্যবহার না করতো। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরকে ঐ তালিকা ধরে অনেক সময় শাস্তি দিয়েছে বা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘ঐ তালিকা অনুযায়ী একসময় বের হলো কিশোরগঞ্জের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী জিল্লুর রহমান (সাবেক রাষ্ট্রপতি)। আর দুই নম্বর হলো হামিদ সাহেব (রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ)। পরে আমি খোঁজ নিতে বলায় দেখা গেল পাকিস্তান আমলের সেই তালিকা রয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বলেছিলাম এটাকে অমিট (বাতিল) করে ফেলতে। কিন্তু সেটা আসলে থেকেই যায়। আর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ভুল হয়েছে যে, তারা সেই তালিকায় ‘কলাবরেটর হিসেবে’ যাদের নামে মামলা তাদের নিয়ে গিয়ে গোলমাল করে ফেলেছে এবং সেখানে যারা মুক্তিযোদ্ধা তাদেরও অনেকের নাম চলে এসেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেখানেও প্রায় এক হাজারের মত নাম বাদ দেয়া ছিল। তবে, সেটা এরমধ্যে কি করে ঢুকলো আর ওয়েবসাইটে চলে গেল সেটা একটা রহস্য বটে।’
তিনি বলেন, ‘রাজকারদের যে তালিকা তা আলাদা গেজেট করা রয়েছে। সেটা আইনগতভাবেই গেজেট করেই করা। আলবদরদের গেজেট করা আছে আলাদা। আল শামস, রাজকার সকলের নামের গেজেট নোটিফিকেশন করা রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের জন্য আমরা যখন ট্রাইব্যুনাল করে (যুদ্ধাপরাধের বিচার) বিচার করতে শুরু করি, তখন ঐ গেজেট থেকেই তালিকা নিয়ে আমাদের বিচারকার্য চলেছে। কাজেই এখানে একটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি বলেন, আমি এগুলো বের করে বলেছিলাম সব আলাদা করে নষ্ট করে দেয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। অর্থাৎ যারাই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন তাদেরকে তারা (পাকিস্তান সরকার) সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে মামলাও দিয়েছে। এরকম বহু ঘটনা রয়েছে। আমরা পাকিস্তান আমলের সব আইন আবার নতুনভাবে করে দিচ্ছি, যা স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ’৯৬ সালে সরকারে এসে এ ধরনের আইন সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নিলেও পরবর্তীতে খালেদা জিয়া আসার পর সেগুলো আর হয়নি। এখন আবার শুরু করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, সব দেশেই রাষ্ট্র পরিচালনার একটা ধারাবাহিকতা থাকে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে এই আইনগুলোকে আমরা আবার নতুন করে তৈরি করি। উচ্চ আদালত থেকে জিয়ার ও এরশাদের ক্ষমতা দখল অবৈধ ঘোষণা করেছে। কাজেই সেখানেও কোন কোন আইন আমাদের জন্য প্রযোজ্য। সেগুলো আমরা রেখেছি। তিনি বলেন, এজন্য আমরা একটা কমিটি করে দিয়েছিলাম বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে। সেখানে অনেক আইনজীবী ছিলেন এবং আমাদের বর্তমান জাতীয় সংসদের স্পিকারও ছিলেন। তারা এটা যাচাই-বাছাই করে দিয়ে গেছেন এবং সেভাবেই আমরা নতুন আইন পাস করে দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা তালিকা দেখেছেন তাদের সকলের মনে খুব কষ্ট লেগেছে। তারা আঘাত পেয়েছেন। আসলে আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে বলেছিলাম, এটা তাড়াহুড়ো করে এখন করতে যাবেন না। আমার সঙ্গে যখন দেখা হলো তখন বলেছিলাম এখন এটা করলে ঝামেলা হতে পারে। এখানে মিলিটারি ডিক্টেটররা কি করে রেখে গেছে সেগুলো আমাদের আগে একবার দেখতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এবার বিজয় দিবস চমৎকার এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমগ্র বাংলাদেশে উদযাপিত হয়েছে। আর তখন এটা আসাতে (রাজাকারের তালিকা) যারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এবং আনন্দঘনভাবে বিজয় দিবস উদযাপন করবে তাদের মনে কতটা আঘাত লাগতে পারে সেটা আমি উপলদ্ধি করতে পারি।
তিনি বলেন, ‘এজন্যই তাদের বলবো- তারা রাজাকারের লিস্টে থাকতে পারে না। তা কখনো হতে পারে না। তারা এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকুক। আর এটা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে’।
তিনি আরও বলেন, রাজকার, আলবদর, আল-শামস গেজেটেড। একাত্তরে বিভিন্ন পত্রিকাতেও এগুলো ছাপা রয়েছে। আমাদের টাইব্যুনাল যখন হয়, তখন করাচি থেকেও অনেক পত্রিকার কাটিং আমরা নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো আমরা সংগ্রহ করেছি। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের যে সব পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে সেগুলোও আনা হয়েছে। কাজেই এই তালিকা কোনমতেই রাজাকারের তালিকা না। এখানে কিছু কলাবরেটরের তালিকা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরেকটি বিষয় আমি স্পষ্ট করতে চাই- সেটা হচ্ছে আমাদের দেশে কিন্তু গেরিলা যুদ্ধ হয়েছে। গেরিলা যুদ্ধে সাধারণত যেটা করা হয় গেরিলাদের আসা, তাদের থাকা, অস্ত্র রাখা এবং যুদ্ধ করার জন্য তাদের শেল্টার দরকার হয়। সারা বাংলাদেশে এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, বাড়ির মুরুব্বিকে শান্তি কমিটির মেম্বার বা চেয়ারম্যান করে রেখে দিয়েছে আর পেছনে তার বাড়ির সদস্যরা, মা-বোনেরা ভাত রেধেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, অস্ত্র রেখেছে, তাদের কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছে।
তিনি বলেন, তাদের সামনে রাখা হয়েছে এই কারণে যাতে তাদের বাড়িতে যাতে কখনও আর্মি না আসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতে না পারে। তাদেরকে শেল্টার দেয়ার জন্য। আর পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকমের সহযোগিতা তারা করেছে। সে কারণে স্বাধীনতার পর জাতির পিতা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানেই বিপ্লব হয়, যেখানেই গেরিলা যুদ্ধ হয় এটা সেখানকার স্বাভাবিক নিয়ম। সেখানেই সাধারণ ক্ষমাও এজন্য ঘোষণা করা হয়।
তিনি বলেন, অনেক হিন্দু পরিবার থেকে শুরু করে মুসলমান পরিবার, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকে পাকিস্তানী বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচাতে অনেক বাড়িতে তাদের শেল্টার দেয়া হয়েছে। সে সব জায়গায় দেখা গেছে, বৈঠকখানায় শান্তি কমিটি বা এ ধরনের নামধারী কাউকে বসিয়ে রাখা হয়েছে ঢাল হিসেবে। তখনকার এ ধরনের অনেক ঘটনাই আমাদের জানা।
’৭৫-এর পর থেকে দেশে কেবল সামরিক শাসন বলবৎ থাকায় এ ধরনের ঘটনা পত্র-পত্রিকা বা লেখনীতে কম এসেছে বলেও প্রধানমন্ত্রী অভিমত ব্যক্ত করেন।
যে কোন দেশেই বিপ্লবের সময় এমনটি ঘটে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে আর সময় নাই। তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। তখন ট্রাকে ট্রাকে করে অস্ত্র তারা দিয়ে যায়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পরে একটা কথা রটনা হয় যে, সিক্সটিনথ ডিভিশনের সৃষ্টি হয়েছে। যারা আমাদের পক্ষে ছিল না, তারাও অস্ত্র নিয়ে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়। এরকম ঘটনাও ঘটেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারতেন। যদি আমাদের জীবনে ১৫ আগস্টের ঘটনা না ঘটতো তাহলে এগুলো পরিষ্কার হয়ে যেত। আমাদের দুর্ভাগ্য জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতা বিরোধীদের আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসে। তারা সামনে চলে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাতেও তাদের অনেকের নাম ঢোকানো হয়।’
তিনি বলেন, ‘এই আবর্জনা এবং জঞ্জালগুলো আমাদের পরিস্কার করতে হবে। আমরা যদি সেটা করতে পারি তখন দেখবেন অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যাবে।’