জানুয়ারি থেকে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কের সুদহার বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো বাংলাদেশ ব্যাংক। যথাযথ পর্যালোচনা ছাড়া এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে ব্যাংকগুলোর আয়ে বিপর্যয় নামার আশঙ্কায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শে পিছু হটল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের গত ২৪ ডিসেম্বরের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ১ জানুয়ারি থেকে শিল্পের মেয়াদি ও চলতি মূলধন ঋণে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার নির্ধারণ করা হবে।
এ পরিস্থিতিতে আগামী এপ্রিল থেকে সব ধরণের ঋণে ৯ শতাংশ এবং আমানতে ৬ শতাংশ সুদহার কার্যকরের বিষয়ে আবারও ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সোমবার রাতে সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের নিয়ে বৈঠক শেষে তিনি ঘোষণা দেন। এর আগে কয়েক দফায় সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।
জানা গেছে, উৎপাদনশীল শিল্প খাতে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক শিগগিরই একটি সার্কুলার করবে। সার্কুলারে প্রাথমিকভাবে আগামী ১ এপ্রিল থেকে নিয়ন্ত্রিত সুদহার কার্যকরের বিষয়ে বলা হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, হঠাৎ করে ব্যাংকগুলোর ওপর সিঙ্গেল ডিজিট সুদ চাপিয়ে দিলে দায় ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যে কারণে গত রোববার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শে শিল্পঋণে আপাতত সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বেঁধে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক মেয়াদি আমানত নিচ্ছে ১০ শতাংশের বেশি সুদে। হঠাৎ করে ১ জানুয়ারি থেকে শিল্পঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকরে বাধ্য করা হলে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের লোকসানে পড়বে। ব্যাংকগুলোর ব্যবসা সংকুচিত হয়ে আসবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও পিছিয়ে পড়বে।
ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয় ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি। যদিও ওই ঘোষণার পর থেকে সুদহার না কমে বরং বাড়ছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা আবারও সোচ্চার হলে সুদহার কমানোর লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রীর পরামর্শে গত ১ ডিসেম্বর সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কমিটি গত ১২ ডিসেম্বর তাদের প্রতিবেদনে শিল্পঋণে এক অঙ্কের সুদহার বেঁধে দেওয়ার সুপারিশ করে। তবে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকরের জন্য সরকারি তহবিলের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ ওই সুপারিশ গ্রহণ করে।
১৯৮৯ সালে নিয়ন্ত্রিত সুদহার ব্যবস্থা থেকে সরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বেশ আগে থেকে কৃষিঋণে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারিত আছে। এ ছাড়া প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদহার নির্ধারিত আছে। বেশি সুদের কারণে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এমন মতামত দিয়ে সম্প্রতি শিল্প খাতে আবার নিয়ন্ত্রিত সুদহার চালুর ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। আর ঋণ রয়েছে ১০ লাখ কোটি টাকার মতো। এসব ঋণের মধ্যে ৪০ শতাংশের মতো রয়েছে উৎপাদনশীল শিল্পঋণ। এসব ঋণে বর্তমানে যে হারেই সুদ থাকুক, ১ জানুয়ারি থেকে তা ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল।
ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠক: ১ জানুয়ারি থেকে শিল্প ঋণে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির বিষয়টি চূড়ান্ত ছিল। তবে রোববার সন্ধ্যার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গভর্নর ফজলে কবিরের বৈঠকের পর আপাতত এটি কার্যকর করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সোমবার গুলশানের জব্বার টাওয়ারে বিএবি কার্যালয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অর্থমন্ত্রী।
বৈঠকে শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, শুধু শিল্পখাতে নয়, সব ঋণে সুদহার হতে হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। এ জন্য প্রয়োজনে সময় দিতে বলেছেন। তিন মাস পর অর্থাৎ ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ শতাংশ এবং আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ।
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে বেশি সুদে আমানত নিয়েছে। এজন্য তাদেরকে সময় দেওয়া হচ্ছে। এরপর তারা স্বল্প সুদে আমানত নেবে আর স্বল্প সুদে ঋণ দেবে। এটি কার্যকর করতে সরকারের যে ধরনের সহযোগিতা দরকার, তা করা হবে। সরকারি সংস্থার আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হবে।
সব ব্যাংক যাতে আমানত পায় তার জন্য নিয়ম করে দেওয়া হবে। মূলধন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো সরকারি আমানত পাবে। তবে প্রতিযোগিতার জন্য সরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে সরকারি আমানতের সুদহারে সামান্য ব্যবধান থাকবে। কোনভাবেই ব্যাংকগুলো ৬ শতাংশের বেশি সুদ অফার করতে পারবে না।
বিএবি ও এপিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ১ এপ্রিল থেকে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকর করা হবে। এ জন্য তাদের নতুন কোনো দাবি নেই। আগে ঘোষণা দিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা না পাওয়ায় কার্যকর করা যায়নি। এখন অর্থমন্ত্রী সরকারি আমানতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে তারা এই সুদহার বাস্তবায়ন করবেন। আগে ব্যর্থ হলেও এবার অবশ্যই সফল হবেন।