বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগনের জীবনী অবলম্বনে বাংলাদেশ-ইতালির যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হচ্ছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য ফাদার: অ্যান আনটোল্ড স্টোরি’।
কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের চিত্রনাট্যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করছেন নির্মাতা হেমন্ত সাদীক।
ফাদার রিগনের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ইতোমধ্যে অডিশন শুরু হয়েছে; ইতালির ভিসেনজাসহ দুই শহরে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর অডিশন নেওয়া হয়েছে বলে গ্লিটজকে জানান হেমন্ত সাদীক।
“ফাদার রিগনের চরিত্রের জন্য ইতালির কোনো অভিনেতাকে চূড়ান্ত করব। অডিশনে সেখানকার অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে দারুণ সাড়া পেয়েছি। দূর-দূরান্ত থেকে এসেও অনেকে অডিশন দিয়েছেন। যাচাই-বাছাই শেষে একজনকে আমরা চূড়ান্ত করবো শিগগিরই।”
নির্মাতার ভাষায়, “আমরা যখন পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আসক্ত হচ্ছি তখন বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রেমে পড়েছেন ফাদার রিগন; আত্মপরিচয়ের জায়গা থেকে সেই বিষয়টি তুলে আনতেই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করছি।
পঞ্চাশের দশকে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন ফেলে ফাদার মারিনো রিগন যখন বাংলাদেশের মোংলায় এসেছিলেন তখন সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নাজুক।হেমন্ত সাদীক বলেন, “নিজের পেশার বাইরে তিনি বাংলাদেশের মানুষ, শিল্প-সাহিত্যের জন্য যে কাজ করে গেছেন সেটাই উঠে আসুক চলচ্চিত্রে; এতে আমরা অনুপ্রাণিত হব।”
ফাদার রিগন ছাড়াও চলচ্চিত্রে তার বোন সিয়েতার চরিত্রও থাকবে; ইতালির কোনো অভিনয়শিল্পী সিয়েতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
এছাড়া আশির দশকে ফাদার রিগনের সঙ্গে নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপার স্মৃতিচারণা উঠে এসেছে চিত্রনাট্যে; তারুণ বয়সের নিপার চরিত্রে বাংলাদেশের কোনো অভিনয়শিল্পী অভিনয় করবেন।
সবকিছু গুছিয়ে চলতি বছরের এপ্রিলের শেষভাগে ইতালির ভেনিস ও ভিসেনজা অঞ্চলে সিনেমার দৃশ্যধারণ শুরু করতে চান নির্মাতা সাদী। ইতালিতে ৩০ ভাগ দৃশ্যধারণ শেষে বাকি অংশের দৃশ্যধারণ হবে বাংলাদেশের খুলনা, মোংলা ও যশোর অঞ্চলে।
চলচ্চিত্রের ইতালীয় অংশের নির্বাহী প্রযোজকের দায়িত্বে আছেন রোকো কোসেনতিনো, আর বাংলাদেশ অংশের অন্যতম নির্বাহী প্রযোজক লিজা আসমা।গ্লিটজকে লিজা জানান, ইতোমধ্যে ফাদার রিগনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন।
মারিনো রিগন ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের কাছে ভিল্লভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন। দেশের নানা জায়গা ঘুরে মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে থিতু হন এবং সেখানে চার্চ ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে তার কাজ ধর্ম প্রচারের গণ্ডির মধ্যে থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, চিকিৎসা সেবা ও দুঃস্থ নারীদের উন্নয়নে তিনি সব সময় উদ্যোগী ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল তার অকুণ্ঠ সমর্থন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে নিজের চার্চে তিনি গোপনে একটি চিকিৎসা ক্যাম্প খোলেন।
সেই ক্যাম্পে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ফিরে গেছেন রণাঙ্গনে। মুক্তিযুদ্ধের হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রমও তাদের একজন।মুক্তিযুদ্ধে ফাদার মারিনো রিগনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়। ২০১২ সালে তাকে দেওয়া হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।
তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতাধিত বই সরাসরি বাংলা থেকে ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন লালনের ৩৫০ টি গানও।
তার উদ্যোগে ইতালিতে একাধিক বাংলা নাটক ও নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নামে ইতালির একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণ করেছেন তিনি।
২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ৯২ বছর বয়সে জন্মস্থান ভিসেনজায় মৃত্যু হয় তার। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়; ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর মংলার শেলাবুনিয়ায় সমাহিত করা হয়।