প্রাচীনকালের মানুষের রাতের আকাশ সম্পর্কে শুধু আগ্রহ এবং বিস্ময়ই ছিল না; ছিল যাচাই করে দেখার প্রবণতাও। ব্যাবিলন এবং মিসরের প্রাচীন পর্যবেক্ষকরা রাতের আকাশের জ্যোতিস্কদের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করেছেন খালি চোখে যতটুকু সম্ভব। তারা এদের গতিবিদ্যা বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং সেই সূত্রে মডেল নির্মাণ করেছেন। এ মডেলগুলো ছিল মোটামুটি চলনসই মডেল; তবুও এক রকমের মডেল বা মানসিক নির্মাণ। এভাবে গ্রহণ সম্পর্কে ব্যাবিলনীয়দের এবং ক্যালেন্ডার সম্পর্কে মিসরীয়দের ভালো কাণ্ডজ্ঞান তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এদের তুলনায় প্রাচীন গ্রিক জ্যোতির্বিদদের একটা বড় কৃতিত্ব হলো, পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্যের আকার, দূরত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য পরিমাপ করতে পারা। অবশ্যই সে সব পরিমাপ নিখুঁত কিছু ছিল না। হওয়া সম্ভবও ছিল না। কিন্তু মানবেতিহাসে এই প্রথম তারা ফলিত গণিতের বাস্তব প্রয়োগে আকাশের জ্যোতিস্ক সম্পর্কে পরিমাণগত কিছু ফলাফল প্রকাশ করলেন। ভেবে দেখলে বোঝা যায়, প্রকৃতি সম্পর্কে তারা দৈনন্দিন ভয়ডরের ঊর্ধ্বে উঠে প্রাকৃতিক কাণ্ডজ্ঞানের সাহায্যে মানসিক ছবি নির্মাণ করতে পেরেছেন, যাচাই করতে চেয়েছেন। এর পেছনে অবশ্যই ছিল ব্যাবিলনীয় এবং মিসরীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঐতিহ্য। ব্যাবিলনীয়দের ছিল দীর্ঘ আকাশ পর্যবেক্ষণের ইতিহাস। ফলে গ্রহণ এবং বিবিধ জ্যোতিস্ক সংক্রান্ত চক্র তাদের জানা ছিল, কেননা তাদের ছিল ৮০০ বছরের আকাশ পর্যবেক্ষণের দীর্ঘ ইতিহাস। লিখিত পর্যবেক্ষণের ইতিহাস ছিল বলেই তারা গ্রহণ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম ছিলেন। এদিকে মিসরীয়দের ছিল জমি পরিমাপের বাস্তব অভিজ্ঞতা। ফলে জ্যামিতি বিষয়ে তাদের ছিল প্রত্যক্ষ সংযোগ। এই দুই প্রাচীন সভ্যতার সংস্পর্শে থাকায় গ্রিকরা প্রাচীন জ্ঞানের চমৎকার সংশ্নেষণ করতে পেরেছিলেন।
যে কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদানের পেছনে থাকে একটা মডেল নির্মাণ। এটি একটি মানসিক কল্পনাসৃজিত পদ্ধতি। যেমন সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথ সংক্রান্ত ধারণাটিতে ‘কক্ষপথ’ বলতে আমরা যেটা বুঝি বা বোঝাই সেটাও একটা কাল্পনিক সৃজন। আকাশের বিবিধ জ্যোতিস্ক সম্পর্কে প্রাচীন গ্রিকদের কৌতূহল ছিল। তারা ঐশী শক্তির সাহায্য ছাড়া প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। এ জন্য তারা মডেল নির্মাণের পাশাপাশি পরিমাপ করে দেখেছেন। এমনকি তারা আকাশের জ্যোতিস্ককেও মেপে দেখার প্রয়াস নিয়েছিলেন। চাঁদ ও সূর্যের গ্রহণ সম্পর্কে তাদের একটা পূর্বানুমান অবশ্যই ছিল। এবং গ্রহণ থেকে তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, পৃথিবী আসলে গোল। গ্রহণ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ধারণা সম্পর্কে জানা যায় যে, আয়নীয় চিন্তাবিদ আনাক্সাগোরাস খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে এ সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। চাঁদের উজ্জ্বল দিক সর্বদাই সূর্যের দিকে ফেরানো থাকে। পারমেনাইডিসের এই পর্যবেক্ষণ থেকে আনাক্সাগোরাস এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, সূর্যের আলোতেই চাঁদ আলোকিত হয়। আনাক্সাগোরাস সম্ভবত এটাও ধারণা করেছিলেন যে, চাঁদের ছায়া যখন পৃথিবীতে পড়ে তখন সেটা সূর্যগ্রহণ হয়। এভাবে পর্যবেক্ষণ ও শুদ্ধ যুক্তির সাহায্যে পারমেনাইডিস বুঝতে পেরেছিলেন পৃথিবী একটি গোলক। এ ঘটনা অ্যারিস্টটলের অনেক আগেকার, যদিও আমরা জানি না তিনি কীভাবে ওই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। অ্যারিস্টটল তার ‘অন দ্য হেভেন্স্’ (আকাশ বিষয়ে) গ্রন্থে পৃথিবীর গোলকত্ব বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রমাণ তুলে ধরেন। তার সারাংশ ছিল এ রকম :
* গ্রহণের সময়ে জ্যোতিস্কের ছায়া সর্বদা গোলাকার। যেহেতু গ্রহণে পৃথিবীর ছায়া পড়ে, তাহলে নিশ্চয় পৃথিবী গোলাকার।
* উত্তর-দক্ষিণে পৃথিবীকে পরিভ্রমণ করলেই বোঝা যায়, জায়গাভেদে নক্ষত্রের অবস্থান বদলায়। এ থেকে বোঝা যায় পৃথিবী গোল এবং সে খুব বড়ও নয়।
স্থানভেদে নক্ষত্রের অবস্থানের এই পর্যবেক্ষিত পার্থক্য থেকে পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে গাণিতিক কোনো সিদ্ধান্ত অবশ্য অ্যারিস্টটল নেননি। সেটা অবশ্য গণিত সম্পর্কে তার মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে, সমুদ্রবন্দর থেকে তাকালে বন্দরগামী দূর জাহাজের প্রথমে মাস্তুল তারপর ক্রমশ অন্যান্য অংশ দৃশ্যমান হয়- এই তথ্য নাবিকদের কাছে সুপরিচিত হলেও অ্যারিস্টটল কিছুমাত্র উল্লেখ করেননি। অ্যারিস্টটলের পূর্ববর্তী অ্যানাক্সিমান্ডার বিশ্বাস করতেন, পৃথিবী চ্যাপ্টা থালার মতো। এ ছাড়া জেনোফিনিস, ডেমোক্রিটাস বা অ্যানাক্সাগোরাস কেউই পৃথিবী যে গোলাকার- সেটা বলে যাননি। তাই অ্যারিস্টটল যে পৃথিবীকে গোলাকার ভাবতেন, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গোলাকার পৃথিবীর ধারণার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, পৃথিবীর ধার থেকে বা উল্টো দিক থেকে মানুষ পড়ে যায় না কেন তার ব্যাখ্যা দেওয়া। অ্যারিস্টটল এ সমস্যার সমাধান করেছিলেন এই বলে যে মাটি ও পানির মতো ভারী জিনিস জগতের কেন্দ্রের দিকে পড়ে, আর তাই পৃথিবী জগতের কেন্দ্রে অবস্থিত। ভারী বস্তু জগতের কেন্দ্রে পতিত হয়- অ্যারিস্টটলের এই ধারণার সঙ্গে আধুনিক মহাকর্ষের ধারণার কিছুটা সাযুজ্য আছে। তবে আধুনিক মহাকর্ষের তত্ত্ব থেকে আমরা জানি যে কোনো বড় ও ভারী বস্তু গোলকে পর্যবসিত হয় এবং সব ভারী বস্তু একে অপরকে নিজেদের দিকে আকর্ষণ করে। অ্যারিস্টটল কিন্তু বুঝেছিলেন যে চাঁদও গোলাকার হবে। চাঁদের কলা পরিবর্তন থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু কেন গোল হবে তার কোনো ব্যাখ্যা তার কাছে ছিল না। সব ভারী বস্তু কেন্দ্রে জমা হয়, পৃথিবী জগতের কেন্দ্রে, তবে চাঁদ তো কেন্দ্রে নয়, তবে সেটি কেন গোলাকার হবে সেটা রহস্য বটে।
৩১০ খ্রিষ্টপূর্বে আয়োনিয়ার সামোস দ্বীপের আরিস্টার্কাস চাঁদ ও সূর্যের দূরত্ব এবং আকার সম্পর্কে গাণিতিক পরিমাপ হাজির করেন। তিনি চারটি স্বীকার্যের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান- (ক) চাঁদকে যখন অর্ধেক দেখায়, তখন চাঁদ ও সূর্যের সংযোগকারী রেখার (পৃথিবীর সাপেক্ষে) মধ্যবর্তী কোণ ৮৭ক্ক; (খ) সূর্যগ্রহণে সূর্যের চাকতিকে চাঁদের চাকতি সম্পূর্ণ ঢেকে দেয়; (গ) পৃথিবীর ছায়া চাঁদের দুইগুণ : চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের দৃশ্যমান চাকতির একধারে পৃথিবীর ছায়ার স্পর্শকাল থেকে পূর্ণ গ্রহণের সময় এবং তারপর ওই সময় থেকে গ্রহণ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত অতিক্রান্ত সময়ের ধারণা থেকে এটা তিনি অনুমান করেছিলেন; (ঘ) চাঁদের আকার রাশিচক্রের অংশ (৩৬০ক্কস্টু ১২ = ৩০ক্ক, ৩০ক্কস্টু ১৫ = ২ক্ক; এখানে আরিস্টার্কাস একটি রাশি বুঝিয়েছেন, পুরো রাশিচক্রে ১২টি রাশি থাকে)।
এসব থকে আরিস্টার্কাস নিচের ৪টি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-
১) পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের ১৯-২০ গুণ বড়।
২) সূর্যের ব্যাস চাঁদের ব্যাসের ১৯-২০ গুণ।
৩) পৃথিবীর ব্যাস চাঁদের ব্যাসের থেকে কয়েক গুণ।
৪) পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব চাঁদের ব্যাসের ৩০-৪০ গুণ।
আরিস্টার্কাসের সময়ে ত্রিকোণমিতি জানা ছিল না। এইসব সিদ্ধান্তে আসতে তাকে অনেক জটিল জ্যামিতিক বিশ্নেষণ করতে হয়েছে। এভাবে সব মহাজাগতিক পরিমাপ তিনি পৃথিবীর ব্যাসের অনুপাতে বের করেছেন- যেমন সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের থেকে গুণ বেশি। যা হোক তার জ্যামিতিক বিশ্নেষণ মোটামুটি সঠিক হলেও তার পরিমাপগুলো ছিল ভীষণ ত্রুটিপূর্ণ, অন্তত আধুনিক নিরিখে। সেটা অবশ্য অপ্রত্যাশিতও নয়, তিনি জমি মাপার জ্যামিতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহাকাশের বিপুল দূরত্বের পরিমাপ নেওয়ার চেষ্টা করছেন, যে ক্ষেত্রে ত্রিকোণমিতি অনেক বেশি অর্থবহ এবং সুচারু পরিমাপ দিতে সক্ষম। যেমন ওপরের (ক) সংখ্যক কোণটি ৮৭ক্ক নয়, বরঞ্চ ৮৯.৮৫৩ক্ক, ফলে সূর্যের দূরত্ব পৃথিবী-চাঁদ দূরত্বের ৩৯০ গুণ যা আরিস্টার্কাসের ধারণার তুলনায় বেশি। আবার (খ) অংশে চাঁদের কৌণিক বিস্তার ২ক্ক এর কথা বলা আছে, আধুনিক হিসাবে এটি ০.৫১৯ক্ক, ফলে পৃথিবী-চাঁদ দূরত্ব চাঁদের ব্যাসের ১১১ গুণ হয়! আরিস্টার্কাসের সময়ে দুরবিন ছিল না। খালি চোখের পর্যবেক্ষণ থেকে জ্যামিতির সাহায্যে তিনি যে এই সব মহাজাগতিক পরিমাপ গ্রহণ করেছিলেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। একটি চমৎকার বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞানের মাধ্যমে তিনি সম্পূর্ণ অজানা একটি রহস্যাবৃত বিষয়ে বৈজ্ঞানিক বিচার-বিবেচনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে তার কাজের ধরনে আমরা গণিতের ফলিত প্রয়োগের ধারা দেখতে পাই। তার লেখনীর ধরণে আমরা ইউক্লিডের ছায়া দেখতে পাই। তিনি প্রথমে স্বীকার্য ঠিক করে নিলেন, অতঃপর অবরোহী পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। একটা কথা অবশ্য বলতেই হয়, যেহেতু তিনি বলেছেন ওগুলো ‘স্বীকার্য’, পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ডেটা নয়, অতএব ওইসব স্বীকার্যের ভিত্তিতে করা পরিমাপ সঠিক বলে দাবি করার কোনো দায় থাকছে না। তবুও তিনি কতকগুলো বিষয়ে কাছাকাছি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। সূর্য যে পৃথিবী থেকে অনেক বড়, অন্তত (৩৬১/৬০)৩ বা পৃথিবীর আয়তনের ২১৮ গুণ, এটা তিনি বের করেছিলেন। আড়াই হাজার বছর আগে, খালি চোখের পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ কথা নয়।
পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্বের পরিমাপ আরও বিশুদ্ধভাবে করেছিলেন প্রাচীন গ্রিক জগতের সবচেয়ে যশস্বী জ্যোতির্বিদ হিপার্কাস। খ্রিষ্টপূর্ব ১৬১ থেকে ১২৭ অবধি আলেকজান্দ্রিয়া নগরে বসে হিপার্কাস বহুবিধ পর্যবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু তার প্রায় সব লেখাই হারিয়ে গেছে। তার সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি সেটা ক্লডিয়াস টলেমির মাধ্যমে যিনি তিনশ’ বছর পরের মানুষ। ১৮৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ১৪ই মার্চ আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি সূর্যগ্রহণ হয়। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে দেখা গেল যে গ্রহণটিতে সূর্যের চাকতি পুরোপুরি ঢাকা পড়েছে (অর্থাৎ চাঁদ সূর্যকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে)। ফলে চাঁদ ও সূর্যের চাকতির আপাত ব্যাস ০.৫৫ক্ক বলে তিনি নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। এখন ওই শহর থেকে খানিকটা দূরে হেলিসপয়েন্ট শহরে একই গ্রহণে দেখা যায় সূর্যের চাকতি মাত্র চার-পঞ্চমাংশ ঢাকা পড়েছিল। কাজেই এই দুই শহরে (হেলিসপয়েন্ট এবং আলেকজান্দ্রিয়া) পৃথিবীর সঙ্গে চাঁদের সংযোগকারী দিকরেখাদ্বয়ের কৌণিক পার্থক্য ০.৫৫ক্কস্ট ৫=০.১১ক্ক। সূর্যের আপাত অবস্থান থেকে ওই দুই শহরের অক্ষাংশও তিনি নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। চান্দ্রমাসে প্রতিদিন চাঁদের কলার ক্রমপরিবর্তন ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে তিনি চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করেছিলেন পৃথিবীর ব্যাসের ৭১ থেকে ৮৩ গুণ। এখন আমরা জানি, এই দূরত্বের গড় হলো ৬০ গুণ। হিপার্কাসের আরেকটি বড় অবদান হলো ৮০০ তারার একটি তালিকা প্রস্তুত করা। সেসব কিছুই আমরা দেখতে পারি না, কিন্তু জেনেছি টলেমির বইয়ের মাধ্যমে। তারা তালিকার কাজ করতে গিয়ে হিপার্কাস লক্ষ্য করলেন কিছু কিছু তারার অবস্থান, প্রাচীন দার্শনিকরা যেমন বলে গেছেন তার থেকে, বদলে গেছে। হিপার্কাসের প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে টিমোকারিস চিত্রা (ঝঢ়রপধ) নক্ষত্রটির অবস্থান যেমন বলেছিলেন, তারাটি তার থেকে সরে গেছে। হিপার্কাস মেপে দেখলেন এই বদল প্রায় ২০। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে হিপার্কাস অনুধাবন করলেন যে নক্ষত্র নড়েনি, নড়েছে বিষুববিন্দু। অর্থাৎ পৃথিবীর অক্ষই নড়বড়ে। ফলে তিনি হিসাব করলেন নক্ষত্রের অবস্থান ১০ নড়াতে যদি ৭৫ বছরের প্রয়োজন হয়, তাহলে রাশিচক্রের পুরো ৩৬০০ ঘুরে আসতে সময় লাগবে প্রায় (৩৬০দ্ধ৭৫ =) ২৭,০০০ বছর। পরবর্তীতে মঘা (Regulus) নক্ষত্রের অবস্থান বদল থেকে টলেমি এই চলনের পরিমাপ নিয়েছিলেন প্রতি ১০০ বছরে ১০। এখন আমরা জানি এই পরিবর্তন সম্পূর্ণ হতে সময় নেয় ২৫,৭২৭ বছর। আইজাক নিউটন প্রথম দেখালেন যে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের এই ঘূর্ণনের কারণ হলো চ্যাপ্টা পৃথিবীর ওপর চাঁদ ও সূর্যের যৌথ আকর্ষণ। এটিকে বলে অয়নচলন (Precession of equinoxes)। বিরাট ব্যাপারটি খালি চোখে পর্যবেক্ষণ, জ্যামিতিক বিশ্নেষণ আর সাহিত্য পাঠ থেকে হিপার্কাস নির্ণয় করে ফেলেছিলেন।
এ পর্যন্ত আরিস্টার্কাস এবং হিপার্কাস চাঁদ ও সূর্যের আকার ও দূরত্ব সম্পর্কে যেসব হিসাব-নিকাশ করেছিলেন তা সবই পৃথিবীর ব্যাসের নিরিখে। অর্থাৎ এটা পৃথিবীর ব্যাসের অত গুণ, সেটা পৃথিবীর ব্যাসের তত গুণ ইত্যাদি। কাজেই পৃথিবীর ব্যাস মাপার একটা প্রয়োজনীয়তা ছিলই। সেই কাজটিই করলেন এরাটোস্থেনিস। তার জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে লিবিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরীয় সাইরিন শহরে। তিনি চমৎকার উপায়ে পৃথিবীর আকার পরিমাপ করেছিলেন। এই ঘটনাটি লিপিবদ্ধ আছে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০-এর পরে লিখিত স্টয়িক দার্শনিক ক্লিওমেডিসের লেখনী থেকে। এরাটোস্থেনিস জানতেন যে আলেকজান্দ্রিয়ায় মধ্যাহ্ন সূর্য সংক্রান্তির সময়ে (Solstice) খাড়া মাথার ওপর থেকে ৭.২০ সরে থাকে (পূর্ণ বৃত্তের প্রায় ১/৫০ অংশ : ৩৬০দ্ধ৫০)। অথচ আলেকজান্দ্রিয়ার ঠিক দক্ষিণ সাইন শহরে সূর্য থাকে ঠিক মাথার ওপর। এই দুই পরিমাপের সাহায্যে এটা হিসাব করা যায় যে পৃথিবীর পরিধি আলেকজান্দ্রিয়া-সাইন দূরত্বের ৫০ গুণ। আধুনিক হিসাবে এই অনুপাত ৪৭.৯। কাজেই এরাটোস্থেনিস মোটামুটি চমৎকার পরিমাপই গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আসলে পৃথিবীর পরিধি এবং আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কর্কটক্রান্তি রেখার দূরত্বের অনুপাত মেপেছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ার অক্ষাংশ ৩১.২০ এবং কর্কটক্রান্তির ২৩.৫০। কাজেই পৃথিবীর পরিধি কর্কটরেখার দূরত্ব = ৩৬০ক্ক (৩১.২-২৩.৫)ক্ক = ৩৬০ক্ক ৭.৭ক্ক = ৪৬.৭৫ক্ক। এরাটোস্থিনিস জানতেন ওই দুই শহরের দূরত্ব কত। সেই সময়ে এমন সব মানুষ ছিল যারা নির্দিষ্ট পদযোগে হেঁটে শহর থেকে শহরের দূরত্ব মাপতে পারতেন। এভাবে ওই দুই শহরের দূরত্ব জানা ছিল ৫০০০ স্টেডিয়া। এই ‘স্টেডিয়া’ আসলে ঠিক কত দূরত্ব সঠিকভাবে জানা যায় না। কিন্তু সে যা হোক, আনুপাতিক ধ্রুবকটি জানাটাও কম গুরুত্বের নয়। কী আশ্চর্যের বিষয় যে মাত্র দুটি শহরে ছায়ার দৈর্ঘ্য মেপে বিশাল পৃথিবীর পরিধি মেপে ফেলা গেল! এই পরীক্ষা আজও স্কুলের বাচ্চারা করে। এভাবেই প্রাচীন গ্রিকরা মহাজাগতিক পরিমাপ সাধন করেছিলেন।