রোহিঙ্গা গণহত্যা: আইসিজের এখতিয়ার ও সম্ভাব্য রায়

Untitled-1-samakal-সমকাল-5e261102ce186

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) কয়েক দিনের মধ্যে প্রাথমিক রায় ঘোষণা করবেন বলে জানা যাচ্ছে। অনেকে আইসিজের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতকে (আইসিকে) মিলিয়ে ফেলেন। আইসিজে জাতিসংঘের ৬টি অঙ্গের একটি এবং নিজস্ব বিধি দ্বারা পরিচালিত। এর মূল কাজ রাষ্ট্রগুলোর বিরোধ দেওয়ানি বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা। তবে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উভয় রাষ্ট্রকেই সম্মত হতে হবে। কোনো ব্যক্তি মামলার বাদী বা বিবাদী কোনোটাই হতে পারেন না। পারস্পরিক সম্মতিই এই আদালতের এখতিয়ারের পূর্বশর্ত হলেও এ আদালতের ৬৫ অনুচ্ছেদ ক্ষমতা দিয়েছে কোনো বিষয়ের ওপর মতামত ব্যক্ত করার। সে ক্ষেত্রে সম্মতির প্রয়োজন নেই। তবে মতামত ব্যক্ত করার অনুরোধ আসতে হবে হয় নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদ অথবা সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো বিশেষায়িত সংস্থা থেকে।

আইসিজের এখতিয়ার :৩৬ অনুচ্ছেদে এর এখতিয়ারের কথা বলা আছে। অধ্যাপক ব্রাউনলিসহ খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের মতে, মূলত চারটি পদ্ধতির একটি দ্বারা আইসিজেকে এখতিয়ার দেওয়া যায়। এর মধ্যে সর্বাধিক প্রযোজ্যটি হলো দুই বা ততোধিক দেশ যদি সম্মতির মাধ্যমে আইসিজেকে এখতিয়ার প্রদান করে। আর একটি পদ্ধতি হলো- যদি কোনো বহুজাতিক চুক্তির মাধ্যমে চুক্তিভুক্ত দেশগুলো আইসিজেকে চুক্তির সময়েই এখতিয়ার প্রদান করে।

জাম্বিয়া চুক্তি পদ্ধতির পথ ধরেই আইসিজেতে বর্তমান মামলাটি করতে পেরেছে। কেননা, মিয়ানমার ও জাম্বিয়া উভয় রাষ্ট্রই ১৯৪৮ সালের গণহত্যা নিরোধ নামক বহুজাতিক চুক্তির পক্ষ। এই চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদ, এই চুক্তির ব্যাখ্যা, প্রয়োগ অথবা বাস্তবায়ন নিয়ে চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে চুক্তিভুক্ত যে কোনো দেশ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আইসিজেতে মামলা করতে পারে। গণহত্যা বিষয়ে আইসিজের এখতিয়ার মেনে নিয়েছে বলে মিয়ানমার গণহত্যার প্রশ্নে আইসিজের এখতিয়ার ও রায় মানতে বাধ্য।

মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তি : প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারের যুক্তি এই যে, এই মামলা আইনের দৃষ্টিতে অচল। যেহেতু জাম্বিয়া ভুক্তভোগী দেশ নয়, তাই সে এ মামলা করতে পারে না। মিয়ানমারের দ্বিতীয় যুক্তি হলো- গণহত্যা প্রমাণ করতে হলে শুধু হত্যা বা শারীরিক-মানসিক নির্যাতনই যথেষ্ট নয়; প্রমাণ করতে হয় গণহত্যার অভিপ্রায়ও। মিয়ানমার বলেছে, বিষয়টি রাষ্ট্রীয় বিচারের বিষয়; আন্তর্জাতিক বিচারের আওতাধীন নয়।

আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের বিশ্নেষণ নিরীক্ষা করে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই এটা বলা যায়, মিয়ানমারের যুক্তি নাকচ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্রথম যুক্তি, যাকে আইনের ভাষায় ‘লোকাস স্টেন্ডাই’ বলে, সেটি ধোপে টেকার মতো নয়। কেননা, গণহত্যা কনভেনশনের বিধানগুলো নিরীক্ষা করলে বোঝা যায়, গণহত্যার জন্য মামলা করার অধিকার রোম চুক্তিভুক্ত সব দেশেরই রয়েছে। চুক্তির ভাষ্য থেকে এটি পরিস্কার- গণহত্যা একটি আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয় বিধায় এতে প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই মামলা করারও অধিকার রয়েছে। তা ছাড়া কোনো রাষ্ট্র গণহত্যার ভুক্তভোগী হতে পারে না। ভুক্তভোগী হয় এক বা একাধিক মানবগোষ্ঠী যা ভৌগোলিক সীমারেখা নির্বিশেষে প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই উৎকণ্ঠার বিষয়।

দ্বিতীয় যুক্তিকে আইনের ভাষায় বলা হয় ‘মেনস রিয়া’। বাংলায় ‘অপরাধ করার অভিপ্রায়’। যদিও অভিপ্রায়ের বিষয়টি একান্তই ফৌজদারি মামলার তত্ত্ব, তবুও দেওয়ানি মামলায় এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এ জন্য যে, এই মামলাটি ফৌজদারি আইননির্ভর দেওয়ানি মামলা। কনভেনশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা হয়েছে- এটা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে তবেই আইসিজে গণহত্যা কনভেনশনে প্রদত্ত এখতিয়ারবলে এখতিয়ার গ্রহণ করতে পারবেন।

সংজ্ঞার প্রয়োজনে যা দেখাতে হবে- একটি মানবগোষ্ঠী জাতীয়, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণ অথবা ধর্মীয়ভাবে ভিন্ন অপর এক মানবগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে হত্যা করেছে বা মারাত্মক দৈহিক বা মানসিক নির্যাতন করেছে অথবা ভুক্তভোগী গোষ্ঠীর ওপর এমন কিছু চাপিয়ে দিয়েছে, যার কারণে ওই গোষ্ঠী আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ শুধু অন্য একটি মানবগোষ্ঠীকে হত্যা-নির্যাতন প্রমাণই যথেষ্ট নয়; গণহত্যার অভিপ্রায়ও প্রমাণ করতে হবে আইসিজেকে এখতিয়ার প্রদানের জন্য। রোহিঙ্গা সম্প্রদায় যে আক্রমণকারীদের থেকে ভিন্ন মানবগোষ্ঠী, সেটি নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালগুলো এই মর্মে রায় দিয়েছেন যে, গণহত্যার অপরাধ প্রমাণ করতে গণহত্যা সংঘটনের অভিপ্রায় বা ‘জেনোসাইড ইনটেন্ট’ প্রমাণ করা অপরিহার্য।

‘আণবিক বোমা ব্যবহারের আইনগত দিক’ নিয়ে মতামত প্রদানের মামলায় আইসিজে গণহত্যা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায়ের অপরিহার্যতার কথা ব্যক্ত করেছেন। তবে অভিপ্রায়ের বিষয় নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। কেননা, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিবলে সৃষ্ট সব ক’টি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচারালয় যথা- আইসিসি, আইসিটি আর আইসিটি ওয়াই অভিপ্রায়ের ওপর যে কথা বলেছেন সংক্ষেপে তা হলো এই যে, গণহত্যার সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায় পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো থেকেই আন্দাজ করা যায়। (নাহিমানা মামলা)। এ ক্ষেত্রে- ১. একই জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্য ধরনের অপরাধের প্রস্তুতি পর্ব; ২. অপরাধের ব্যাপকতা; ৩. অপরাধের প্রকৃতি; ৪. অপরাধের এলাকা; ৫. জনগোষ্ঠীকে বিশেষভাবে বাছাই; ৬. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য; ৭. অপরাধের পুনরাবৃত্তি; ৮. ভুক্তভোগী গোষ্ঠীর মৌলিক স্তম্ভকে আঘাত ইত্যাদি তথ্য থেকে অভিপ্রায় আন্দাজ করা যায়। উপাদানগুলোর সব ক’টিই মিয়ানমারে ঘটিত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনে উপস্থিত রয়েছে মর্মে তথ্য-প্রমাণ গাম্বিয়া উপস্থাপন করেছে।

অপরাধগুলো মিয়ানমার তার রাষ্ট্রীয় বিচারের বিষয় বলে যে যুক্তি দিয়েছে, সে যুক্তি আইসিজে ১৯৫৯ সালে ‘ইন্টার হেনডেল’ মামলায় এই বলে নাকচ করেছেন যে, আন্তর্জাতিক চুক্তিভিত্তিক বিরোধ অভ্যন্তরীণ বিচারের বিষয় নয়।

যেসব আদেশ দিতে পারেন :আইসিজে কাউকে জেল-ফাঁসি বা সাজা দেওয়ার আদালত নয়। এর রায় দেওয়ানি আদালতের ডিক্রির মতো। প্রাথমিকভাবে এখতিয়ারের প্রশ্ন গাম্বিয়ার পক্ষে নির্ধারিত হলে, মামলার মূল বিবাদের প্রশ্নে সাক্ষ্য ও শুনানি হবে, যাতে দীর্ঘ সময় লাগবে। মূল অভিযোগ প্রমাণিত হলে যেসব রায় আশা করা যায় তার মধ্যে থাকতে পারে- এই মর্মে ঘোষণা যে মিয়ানমার রাষ্ট্রে গণহত্যা হয়েছে, যা বন্ধ করতে মিয়ানমার ব্যর্থ হয়েছে বা চেষ্টা করেনি। ভবিষ্যতে গণহত্যা বা গণহত্যা চেষ্টা বন্ধ করার আদেশও থাকতে পারে। আরও থাকতে পারে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ এবং যাদের গৃহত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে, তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি ও ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশসহ আনুষঙ্গিক নির্দেশনা। এতে মিয়ানমার একদিকে যেমন প্রবল চাপের মুখে পড়বে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেকটা একঘরে হয়ে যাবে। যদিও আইসিজের রায় শুধু মিয়ানমার ও গাম্বিয়ার মধ্যেই বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ এই রায়ে কোনো পক্ষ হবে না। তাতেও খুব একটা পার্থক্য হবে না এ জন্য যে, গাম্বিয়ার পক্ষে এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ডিক্রি হলে, ভবিষ্যতে গণহত্যা বন্ধের আদেশ হলে, উচ্ছেদকৃত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশ হলে ডিক্রি কোন দেশের পক্ষে- সেটি অবান্তর। কোন দেশের বিপক্ষে হলো, সেটাই বড় কথা। কেননা, রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল নেই (যদিও সীমিত রিভিশনের বিধান রয়েছে) এবং রায় বাস্তবায়িত করার কোনো পদ্ধতিও নেই (নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া), যেটি রাষ্ট্রীয় আদালতের রয়েছে। রায় কার্যকর করার জন্য বাস্তবিক অর্থে কোনো পদক্ষেপের পদ্ধতি না থাকায় বাংলাদেশ পক্ষ হলো কি না হলো, তাতে কিছু আসে যায় না। জাতিসংঘ সনদের ৯৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব সদস্যরাষ্ট্র আইসিজের সিদ্ধান্ত মানবে বলে অঙ্গীকারবদ্ধ। কোনো দেশ তা না মানলে অন্যপক্ষ নিরাপত্তা পরিষদে নালিশ করতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদ প্রয়োজন মনে করলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মিয়ানমার রায় বাস্তবায়ন না করলে গাম্বিয়াই নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি নিতে পারবে। তবে সিদ্ধান্ত নিরাপত্তা পরিষদের, আইসিজে নিরাপত্তা পরিষদকে বাধ্য করতে পারেন না।

প্রাথমিক ও চূড়ান্ত আদেশ যা হতে পারে : প্রাথমিকভাবে আদালত যে আদেশ দেবেন তা হলো এই- মামলা চলতে পারে কিনা। এটাই হবে বলে বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। তার সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ হিসেবে বলতে পারে- সত্বর গণহত্যা ও গণহত্যাচেষ্টা বন্ধ ও রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই মামলার আরজিতে (১১২নং অনুচ্ছেদ) যেসব প্রতিকার চাওয়া হয়েছে তা হলো- গণহত্যা কনভেনশনে যেসব দায়বদ্ধতা অর্পণ করা হয়েছে, সেগুলো যেন মিয়ানমার পালন করে। যেমন বেআইনি কর্মকাণ্ড বন্ধ করা; অপরাধীদের আন্তর্জাতিক এখতিয়ারসম্পন্ন ফৌজদারি ট্রাইব্যুনাল বা এ ধরনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত অস্থায়ী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারে পাঠানোর পদক্ষেপ নেওয়া; ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও নাগরিকত্বের অধিকারসহ ফিরিয়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা; এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি হবে না মর্মে আদেশ। আইসিজে ওপরে উল্লিখিত সব ক’টি আদেশ এবং তৎসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক আদেশও প্রদান করতে পারেন। যেহেতু এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিসি) তাদের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তাই অপরাধীদের বিচারে পাঠানোর আদেশ খুব একটা প্রাসঙ্গিক হবে না। আর অস্থায়ী ট্রাইব্যুনাল করতে পারে শুধু নিরাপত্তা পরিষদ অথবা হতে পারে কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির বলে।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি
Pin It