বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ফের তিন হাজার ৩০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে।আড়াই বছর পর অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে উঠল।
প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে আট মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ভর করে রিজার্ভ এই উচ্চতায় উঠেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। আমদানি ব্যয় কমাও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে বলে মনে করেন তিনি।
কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৭ সালের ২২ জুন রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। মাস দুয়েকের মধ্যে তা আরও বেড়ে ৩৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারে উঠে।
আর ওটাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের নীচে নেমে আসে। এরপর আর ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি।
আড়াই বছর পর রোববার সেই রিজার্ভ ফের ৩৩ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, এই আড়াই বছর ধরে রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৫০ থেকে ৩২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উঠানামা করছে।আকু আমদানি বিল পরিশোধের পর ৩২ বিয়িন ডলারের নিচে নেমে গেছে এই সূচক। পরে দুই মাসে একটু একটু করে বেড়ে ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগে থেকেই আমদানি ব্যয় কমছে। করোনাভাইরাসের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের প্রধান আমদানিকারক দেশ চীন থেকে পণ্য না আসায় তা আরও কমে গেছে।
“সে কারণে রপ্তানি আয় কমার পরও রেমিটেন্সের উপর ভর করে রিজার্ভ ফের ৩৩ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।”
রপ্তানি উন্নয়ন বুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আয় কমেছে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ।গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
আমদানি সংক্রান্ত ছয় মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আমদানি ব্যয় কমেছে ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ মজুদ থাকতে হয়।
৮ মাসে ১২.৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স
তবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। রোববার সদ্য বিদায়ী ফেব্রুয়ারি মাসের রেমিটেন্সের তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তাতে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অংক গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ১০ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।
আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফে৳ব্রুয়ারি) রেমিটেন্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৪৯ কোটি ৮৪ লাখ (১২.৫০ বিলিয়ন) ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ৪১ কোটি (১০.৪১ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
দুই শতাংশ হারে প্রণোদনার কারণেই রেমিটেন্সে সুবাতাস বইছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
তবে চীনের উহান থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস চীনের বাইরের দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ায় রেমিটেন্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা করছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস এখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে।অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ধাক্কা দেবে বলে মনে হচ্ছে। আর সে ধাক্কায় বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহও কমবে।
“এখনও অঅমাদের রেমিটেন্সে তেমন প্রভাব পড়েনি। এই রোগ যদি চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে আমাদের রেমিটেন্সে কোনো সমস্যা হত না। কিন্তু এখন অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। যদি মধ্যপাচ্যসহ অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে তাহলে বড় সমস্যা হবে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ‘সুখবর’ নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছর।
প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৫৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।অগাস্টে আসে ১৪৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৪৭ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।
অক্টোবর মাসে আসে ১৬৪ কোটি ডলার। নভেম্বরে এসেছিল ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার।ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে আসে যথাক্রমে ১৬৯ কোটি ১৭ লাখ ও ১৬৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলার।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি।২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি; ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।
রেমিটেন্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।প্রবাসীরা এখন ১০০ টাকা দেশে পাঠালে যার নামে টাকা পাঠাচ্ছেন তিনি ওই ১০০ টাকার সঙ্গে ২ টাকা যোগ করে ১০২ টাকা তুলতে পারছেন।
বাজেটে এ জন্য ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বর্তমানে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। জিডিপিতে তাদের পাঠানো অর্থের অবদান ১২ শতাংশের মত।