করোনাভাইরাস নিয়ে দেশব্যাপী এক ধরনের আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি সর্বত্রই আলোচনার কেন্দ্রে এই ভাইরাস। এ অবস্থায় সবার প্রতি পরামর্শ থাকবে, করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না। কারণ এই রোগে মৃত্যুহার খুব বেশি নয়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, করোনায় মৃত্যুহার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। সুতরাং এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চললেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব হবে।
জ্বর দিয়ে এ রোগের লক্ষণ শুরু হয়। জ্বরের সঙ্গে সর্দি, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীর ব্যথা থাকতে পারে। এক সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। সাধারণ ফ্লুর মতোই হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। সুতরাং আক্রান্ত কাউকে পাওয়া গেলে প্রথমেই তাকে নূ্যনতম ১৪ দিন আলাদা করে রাখতে হবে, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের সংস্পর্শে না যেতে পারে। একই সঙ্গে যারা আক্রান্ত হয়নি, তাদের চলাফেরায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
করোনাভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। লক্ষণগুলো হয় অনেকটা নিউমোনিয়ার মতো। কারও ক্ষেত্রে ডায়রিয়াও দেখা দিতে পারে। তবে মানুষের দেহে ভাইরাসটি সংক্রমণের পর এক থেকে ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দিতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে এ রোগ কিছুদিনের মধ্যে এমনিতেই সেরে যায়। কিন্তু কিডনি, ডায়াবেটিস, হৃদযন্ত্র কিংবা ফুসফুসের পুরোনো রোগীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে এটি নিউমোনিয়া, রেসপিরেটরি ফেইলিউর অথবা কিডনি অকার্যকারিতার দিকে মোড় নিতে পারে। এতে করে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে।
যে কোনো ভাইরাস প্রতিরোধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও সেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এজন্য ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার, গণপরিবহন এড়িয়ে চলা, প্রচুর ফলের রস এবং পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে, ঘরে ফিরে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। কিছু খাওয়া কিংবা রান্নার আগে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে, ডিম কিংবা মাংস রান্নার করার আগে ভালোভাবে সিদ্ধ করে, ময়লা কাপড় দ্রুত ধুয়ে ফেলা, নিয়মিত ঘর এবং কাজের জায়গা পরিস্কার রাখা এবং অপ্রয়োজনে ঘরের দরজা-জানালা খুলে রাখা যাবে না। জনসমাগম এড়িয়ে চলবেন। তাহলেই অনেকটা নিরাপদ থাকা যাবে। তাই কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে পরামর্শ থাকবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া।
আইইডিসিআর হটলাইন চালু করেছে। সেখানে ফোন করে আপনার শারীরিক অবস্থা অবহিত করুন। এরপর প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিন, ভালো থাকুন।
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ
করোনাভাইরাস নিয়ে সাধারণ সব প্রশ্নের উত্তর, জানা জরুরি
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনাভাইরাস আক্রান্তের ঘটনা প্রথম ঘটলেও এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশেও।
করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। করোনা ইস্যুতে বেশ কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং উত্তর দেওয়া হয়েছে ডাব্লিউএইচও’র ওয়েবসাইটে। পাঠকদের জন্য সেসব তথ্য উল্লেখ করা হলো।
করোনাভাইরাস
করোনাভাইরাস হলো মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বিভিন্ন রোগের কারণ। এর আগে মার্স করোনাভাইরাস, সার্স করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখা গেছে।
কোভিড-১৯
করোনাভাইরাসের দাপ্তরিক নাম হলো কোভিড-১৯। এই ভাইরাস ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে ছড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত অজানা ছিল।
করোনাভাইরাসের লক্ষণ
জ্বর, ক্লান্তি এবং শুকনো কাশি হয়। আক্রান্ত রোগীর গায়ে ব্যথা, নাক বন্ধ, নাক দিয়ে পানি পড়া, গলা ব্যথা বা ডায়রিয়া হতে পারে। এসব লক্ষণ শুরুতে খুব হালকা মাত্রায় থাকতে পারে এবং ধীরে ধীরে বাড়তে পারে।
কোনো লক্ষণ বা অসুস্থতা বোধ না করলেও আক্রান্তের ঘটনা ঘটতে পারে। আক্রান্তদের বেশিরভাগ কোনো বিশেষ চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হন। প্রতি ছয় জনের মধ্যে মাত্র একজনের ক্ষেত্রে রোগটি জটিল হতে পারে। তবে যারা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত; তাদের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরির ঝুঁকি বেশি।
যেভাবে করোনা ছড়ায়
করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হাঁচি, কাশির মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। হাঁচির ফলে জীবাণু যেখানে পড়ে সেখান থেকে অন্য কারো হাতে ভাইরাস লেগে যায়। এরপর সেই হাতে নাক, মুখ বা চোখ স্পর্শ করলে শ্বাসতন্ত্রেও সংক্রমণ ঘটে। এমনকি আক্রান্তের হাঁচি-কাশির সময় সেখানকার বাতাস গ্রহণ করেও অন্য কেউ ভাইরাস আক্রান্ত হতে পারেন। এজন্য আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে অন্তত তিন ফুট দূরে থাকা উচিত।
ভাইরাস বাতাসের ছড়ায় কি না ?
করোনাভাইরাস কেবল আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়।
যিনি আক্রান্ত নন, তার মাধ্যমে ছড়ায় কি না ?
করোনাভাইরাস ছড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি। এছাড়া যেসব আক্রান্তের ক্ষেত্রে সংক্রমণের লক্ষণ এখনো প্রকাশ পায়নি, তাদের কাছ থেকে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা খুবই কম।
আক্রান্তের মল থেকে করোনা ছড়াতে পারে ?
আক্রান্ত ব্যক্তির মল থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি সামান্য। তবে প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির মলে ভাইরাসের উপস্থিতি থাকতে পারে।
নিজেকে রক্ষার উপায়
নিয়মিত ও ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। হাঁচি-কাশি যারা দিচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে অন্তত তিন ফুট দূরত্বে থাকতে হবে। চোখ-নাক-মুখে হাত দেওয়া যাবে না। হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় যে স্বাস্থ্যবিধি, তা মেনে চলতে হবে।
অসুস্থ হলে বাড়িতে থাকতে হবে। জ্বর, সর্দি এবং শ্বাসকষ্ট থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এমন এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।
করোনা আক্রান্ত এলাকা থেকে আসা ব্যক্তিদের করণীয়
অসুস্থ বোধ, বিশেষ করে হালকা জ্বর, মাথা ব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়লে বাড়িতে আলাদা থাকতে হবে। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এভাবে একা থাকা দরকার। খাবার বা প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য বাইরে যেতে হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
জ্বর, কাশি ও শ্বাস নিতে অসুবিধা হলে সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আপনি কী পরিমাণ ঝুঁকিতে ?
আপনি যেখানে আছেন, সেখানে কতটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস, সেটা বিবেচনা করতে হবে। বেশিরভাগ জায়গায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার হার খুব কম। তবে যেসব জায়গায় দ্রুত এটি ছড়িয়েছে, সেখানে যারা থাকেন, ভ্রমণ করেছেন তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
যাদের ঝুঁকি বেশি ?
এখন পর্যন্ত এটি নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী বয়স্ক ব্যক্তি এবং যারা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, ফুসফুসের জটিলতার মতো রোগে ভুগছেন তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে কি না ?
অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করে না। কেবল ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে কাজ করে। করোনাভাইরাস যেহেতু ভাইরাস থেকে ছড়ায়, সে কারণে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ করবে না।
ওষুধ আছে কি না ?
করোনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কোনো ওষুধ নেই। যারা সংক্রমিত হয়েছেন তাদের বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। করোনার টিকা ও ওষুধ উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে।
মাস্ক পরা উচিৎ কি না ?
করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেলে এবং অসুস্থতা বোধ করলেই কেবল মাস্ক পরুন। একবার ব্যবহারের পর সেই মাস্ক নষ্ট করে ফেলতে হবে। তবে অসুস্থ বোধ না করলে মাস্ক ব্যবহারের দরকার নেই।
কীভাবে মাস্ক পরবেন, খুলবেন এবং তা ধ্বংস করতে হবে ?
কেবল স্বাস্থ্যকর্মী, কেয়ারটেকার এবং যাদের কোরোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিয়েছে তারাই মাস্ক ব্যবহার করবেন। মাস্ক ধরার আগে অবশ্যই হাত ভালো করে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
মাস্কে কোনো ছেড়া-ফাটা আছে কি না তা পরীক্ষা করতে হবে। মাস্কের কোনটি ওপরের দিক (মেটাল স্ট্রিপ) তা নিশ্চিত হতে হবে।
মাস্ক মুখে পরা এবং মেটাল স্ট্রিপের অংশ নাকে ঠিকমতো লাগানো উচিত। মুখ ও থুঁতনি ঢেকে থাকে এমনভাবে মাস্কটি লাগাতে হবে। ব্যবহারের পর মাস্কটি খুলে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে কানের একপাশ থেকে মাস্কটি খুলতে হবে। যতটা সম্ভব মুখ এবং পোশাকের সঙ্গে স্পর্শ না লাগে এমনভাবে খুলতে হবে।
মাস্ক খুলে ফেলার পর বন্ধ কোনো ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। মাস্ক খোলার পর হাত ভালো করে সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
করোনার লক্ষণ প্রকাশ হওয়ার সময় কতটা ?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া এবং লক্ষণ প্রকাশের মাঝের সময়কে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলে। বেশিরভাগ সময় করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড এক থেকে ১৪ দিন।
প্রাণীর মাধ্যমে মানুষ আক্রান্তের ঝুঁকি
আগেই বলা হয়েছে করোনাভাইরাস ভাইরাসের একটি বিশাল পরিবার। মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণী থেকে আক্রান্ত হয়। তবে এখন পর্যন্ত করোনা অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে ছড়িয়ে কিনা তা জানা যায়নি।
পোষা প্রাণী থেকে কি সংক্রমণ ছড়াতে পারে ?
পোষা প্রাণীর মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কতদিন টিকে থাকতে পারে করোনাভাইরাস ?
আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে কোনো কোনো জায়গায় কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়লে সেখানে কতদিন টিকে থাকতে পারে তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে অন্য করোনাভাইরাসের মতোই এটি আচরণ করে। কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। তবে এটি নির্ভর করে বিভিন্ন রকমের নিয়ামকের ওপর।
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে পারে ধূমপান, একসঙ্গে একাধিক মাস্ক পরিধান এবং নিজের ইচ্ছানুসারে ওষুধ সেবন। আক্রান্তের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।