চিরপ্রাসঙ্গিক বঙ্গবন্ধু : রাষ্ট্রপতি

unnamed

রাষ্ট্র হিসেবে যেমন বাংলাদেশ, ব্যক্তি হিসেবে তেমন আমি একটি বিশেষ সময় পার করছি। ‘বিশেষ সময়’ এ কারণে নয় যে, তৃণমূলে রাজনীতি শুরু করে এখন আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান। বরং আমার কাছে বর্তমান সময়ের বিশেষত্ব এই- আমি যখন রাষ্ট্রপ্রধান, তখনই পালিত হচ্ছে ‘মুজিববর্ষ’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। আগেও বিভিন্ন সময়ে বলেছি- রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার দুই মেয়াদে মুজিববর্ষ নিঃসন্দেহে এক অনন্য মাইলফলক। সন্দেহ নেই যে, সাধারণ নাগরিক হিসেবেও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি যে এই ইতিহাসের অংশ হতে পারছি, তাও নিঃসন্দেহে অনন্য।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আয়োজন আমার কাছে নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং আবেগের অনুষঙ্গ। বস্তুত আমরা যারা ষাটের দশকে বাঙালির রাখাল রাজা শেখ মুজিবের আহ্বানে রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছিলাম, তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন। বঙ্গবন্ধু মানে আমাদের কাছে একটি প্রতীক, একটি আবেগ, একটি হৃদয় নিংড়ানো আহ্বান, একটি নতুন দিগন্তের নাম। আমরা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, স্বজন ও সহযোদ্ধার রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি; তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু যদি ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে’ পড়ার আহ্বান না জানাতেন, তাহলে হয়তো স্বাধীনতা যুদ্ধ এভাবে জনযুদ্ধে পরিণত হতো না।

আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হতো না। তিনি জাতির পিতা কেবল এই কারণে নন যে, স্বাধীনতা-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি জাতির পিতা এই কারণেও যে, এই দেশের যা কিছু- সবই তিনি জন্ম দিয়েছিলেন। এমনকি ‘বাংলাদেশ’ নামটিও তার দেওয়া। বিশ্বে আরও বিভিন্ন দেশের জাতির পিতা রয়েছেন। আমাদের এ অঞ্চলেও রয়েছেন মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কিংবা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কিন্তু কয়টি দেশের জাতির পিতা তার দেশের নামও রাখতে পেরেছেন? জাতির পিতা হিসেবেও বঙ্গবন্ধু সে ক্ষেত্রে অনন্য।

আমি মনে করি, সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের জন্য ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। বাঙালি জাতি সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে সব সময়ই অগ্রগণ্য ছিল। কিন্তু বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল না। বঙ্গবন্ধু এই অগ্রসর জাতিকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র দিয়ে জাতির হাজার বছরের পরিক্রমায় এক অনন্য স্থান অধিকার করে নিয়েছেন। তাই আমরা তাকে বলি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।

দুই.

হাজার বছরের কথা বলি আমরা; কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে বুঝি, একটি জাতির জীবনে একশ’ বছরও কম নয়। সেদিক থেকে নিজেকে আমার পরম সৌভাগ্যবান মনে হয় যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমরা একই আকাশের নিচে থেকেছি। একই বায়ুমণ্ডল থেকে নিঃশ্বাস গ্রহণ করেছি। আমার গোটা রাজনৈতিক জীবনে তারই আদর্শের পতাকা বহন করে নিয়ে চলেছি; এটাও কম গৌরবের নয়। আমি তার জন্মশতবার্ষিকী দেখে যেতে পারছি। বঙ্গবন্ধুর অনেক সহকর্মীর এই সৌভাগ্য হয়নি।

বস্তুত আমার জীবনে বঙ্গবন্ধু ধ্রুবতারার মতো হয়ে আছেন। দীর্ঘ ৭৭ বছরের জীবনে যখন পেছন ফিরে দেখি; দেখতে পাই আমার জীবনের যে অভিমুখ ও অর্জন, সবই বঙ্গবন্ধুর অবদান। মাত্র ২৫ বছর বয়সের আমাকে তিনি জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। আমি হয়েছিলাম তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব একজন তরুণের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া। আমার মতো লাখো তরুণের মধ্যে কেবল নয়, গোটা জাতির ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার তারুণ্য থেকেই তাই বাঙালির স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন। শুধু স্বপ্ন দেখেননি; বাস্তবায়নে রাত-দিন কাজ করেছেন। আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো গোটা জাতি তার পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার স্মৃতি গোটা জীবনে ভোলার নয়। ১৯৬৪ সালের কথা। বাঙালির প্রাণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। আমরা তাকে ‘মুজিব ভাই’ ডাকি। আমি তখন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মুজিব ভাই ওই সময় কিশোরগঞ্জ আসেন আওয়ামী লীগের সমাবেশে। প্রিয় নেতাকে কাছে থেকে দেখব, তার সঙ্গে কথা বলব- এই ইচ্ছা থেকেই ছাত্রলীগের দু-তিনশ’ কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে গেলাম রঙমহল সিনেমা হলের সামনে। ভেতরে জায়গা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদের ঢুকতে দিলেন না। তাদের বক্তব্য, এটা ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান নয়। তারপরও আমরা বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলাম। নেতা বের হলে প্রয়োজনে রাস্তার মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করব, কথা বলব। সন্ধ্যার আগেই সমাবেশ শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে আসছেন। তাৎক্ষণিক স্লোগান ধরলাম- ‘মুজিব ভাই যেখানে, আমরা আছি সেখানে’। বুঝতে পারলাম, দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছি। নেতা এসে জড়িয়ে ধরতেই পরিচয় দিয়ে অভিযোগ জানালাম- ‘আমরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসেছিলাম আপনার বক্তৃতা শুনতে; কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদের হলের ভেতরে ঢুকতে দেননি।’ মুজিব ভাই তখন সবার সামনেই বললেন, ‘আরে আওয়ামী লীগ বাদ দে, তোরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই আমার আসল শক্তি।’ নেতার সেই অভয় বাণী আমার কানে এখনও বাজে। তার আলিঙ্গনের স্পর্শ আমি এখনও অনুভব করতে পারি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিই আমার রাজনীতি। তার জন্য প্রয়োজনে জীবন দেব।

কয়েক বছর পর, ‘৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষিত হলো। নেতার নির্দেশে আমরাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সম্ভবত ‘৬৭ সালের প্রথম দিকে সিলেটে গিয়ে গ্রেপ্তার হলেন তিনি। খবর পেলাম, পুলিশ তাকে বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেনে করে সিলেট থেকে ময়মনসিংহ নিয়ে যাবে। আমরা চার-পাঁচ হাজার ছাত্র জড়ো হয়ে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন অবরুদ্ধ করে ফেললাম। রাত ১২টায় ট্রেন এলো। তাকে রাখা হয়েছিল ফার্স্ট ক্লাসের একটি কামরায়। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সেখানে গেলাম। ‘হামিদ’ বলেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বিস্মিত হলাম, একবারের দেখাতেই নেতা আমার নাম মনে রেখেছেন! ট্রেনের বগির দরজায় দাঁড়িয়ে একটি হ্যান্ডমাইকে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে তিনি ১০-১২ মিনিট বক্তৃতা করলেন। সবশেষে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘আন্দোলন চালিয়ে যা, জয় আমাদের হবেই।’ তারই নির্দেশে পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে কিশোরগঞ্জে সংগঠন গোছানোর কাজ করতে থাকি।

‘৭০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় দেখা করতে এলে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন- ‘তোকে ইলেকশন করতে হবে। তুই এমপিএ ইলেকশনের প্রস্তুতি নে।’ বঙ্গবন্ধুকে জানালাম, এমপিএ নয়; এমএনএ ইলেকশন করতে চাই। কিন্তু তিনি বললেন, ‘তুই ছোট, প্রথমে এমপিএ ইলেকশন কর। পরিচিত হ। পরে বড়টা করবি।’ এপ্রিল মাসে আবার ঢাকায় এলাম দেখা করতে। এবার আমাকে দেখেই তিনি হাসতে লাগলেন। ভাবলাম, আমার কাপড়চোপড়ে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা। হাসতে হাসতেই বঙ্গবন্ধু জানালেন, আমার এলাকায় এমএনএ প্রার্থী সাবেক জজ সাহেব মারা গেছেন। বললেন- ‘আমি কি আর তোর কথা না রাইখা পারি? তুই তো আমার দাদা।’ শেখ আবদুল হামিদ যে বঙ্গবন্ধুর দাদা- সেটা তখনও আমার জানা ছিল না। জজ সাহেব নেই, তাই বঙ্গবন্ধুর মনোনয়ন পেয়ে আমি এমএনএ নির্বাচনে অংশ নিলাম। ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলীর জনসভায় বঙ্গবন্ধু আমার জন্য ভোটও চাইতে গেলেন। কোনো কোনো জায়গায় নৌকা থেকেও বক্তৃতা করলেন। নির্বাচিত হলাম সর্বকনিষ্ঠ এমএনএ হিসেবে।

স্বাধীন দেশের পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমার আগ্রহের কেন্দ্রে। লক্ষ্য করেছি, পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে স্পিকার বিব্রত হতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হতেন না। ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্টে আতাউর রহমান খান, এমএন লারমাসহ বিরোধী দলের কয়েকজন এমপি ছিলেন। তখনও দেখেছি, তারা কথা বলতে চাইলেই সুযোগ পেতেন। প্রায় সময় বঙ্গবন্ধুই স্পিকারকে বলে সে সুযোগ করে দিতেন। আমি সব সময়ই বলি, বঙ্গবন্ধুই আমার রাজনৈতিক গুরু; যা শিখেছি তার কাছ থেকেই শিখেছি। সেই শিক্ষাগুলোই পরে প্রয়োগ করেছি নিজের রাজনৈতিক জীবনে। আমি নিজে জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকা অবস্থায় বিরোধী দলকে যে সুযোগ দিতাম, সেটাও আসলে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই শেখা।

আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, মানুষের সঙ্গে মিশতে পারার অসম্ভব গুণ ছিল বঙ্গবন্ধুর ভেতরে। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন জনগণের কাছে যাওয়ার মাহাত্ম্য। আমার নির্বাচনী এলাকা তো বটেই, পুরো কিশোরগঞ্জে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। কিশোরগঞ্জের এমন কোনো পাড়া-মহল্লা নেই, যেখানকার মানুষকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। মানুষকে নামধামসহ মনে রাখতে পারাটাও আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই শিখেছি। যদিও বঙ্গবন্ধুর মতো স্মৃতিধর হতে পারিনি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক অধ্যায়। এমপি হোস্টেলে থেকে সকালে খবরটি শুনে কত যে কেঁদেছি! আক্ষেপ জেগেছে, বঙ্গবন্ধুকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সাবধান করেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, পঁচাত্তরের ১১ আগস্ট বিকেলে গণভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, আমার কিছু একান্ত কথা আছে। সন্ধ্যার পর গণভবনের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী বলতে চাস?’ আমি কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার তাকে খুলে বললাম। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, ‘একটু ঝামেলা ছিল, সব ঠিক হয়ে গেছে; চিন্তা করিস না।’ ফিরে এলাম আশ্বস্ত হয়ে। এটাই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা, শেষ কথা। এখন বুঝতে পারি, কোনো কিছুই ঠিক ছিল না তখন।

‘৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জে আয়োজিত আলোচনা সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করি। কিছুদিন পর গ্রেপ্তার হই। জেলখানার ভেতরেই জিয়াউর রহমান তার সামরিক সচিব কর্নেল মাহফুজুর রহমানের মাধ্যমে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পাঠান। বলা হয়েছিল, প্রস্তাবটি না মানলে ২৫ বছর জেলে থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতে পারিনি বলে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। জীবনভর বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে তার আদর্শ আঁকড়ে ধরেই থাকতে চেয়েছি। আমার জীবনে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া বাকি নেই। আমি শুধু চাই, এ দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চিরঞ্জীব থাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

তিন.

আমি আরও আনন্দিত যে, মুজিববর্ষ উদযাপন কেবল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সীমিত নেই। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং সর্বোপরি ব্যক্তিগত নানা উদ্যোগে উদযাপিত হচ্ছে বাঙালি জাতির জীবনের এই অবিস্মরণীয় বছর। আমি মনে করি, বেসরকারি বা ব্যক্তিপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের তাৎপর্য বিশাল। তিনি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়’ কবিতার পঙ্‌ক্তি উচ্চারণ করতেন- ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।’ আমি নিজেও তার বক্তৃতায় এই উচ্চারণ একাধিকবার শুনেছি। ফলে বঙ্গবন্ধু যেমন সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন, যেমন সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করেন; তেমনই তার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনেও সাধারণ মানুষের প্রাধান্য পাওয়া উচিত।

একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী যেভাবে উদযাপন করা হচ্ছে, তা নিয়েও আমি ভেবেছি। ভেবেছি যে, কী করলে তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সবচেয়ে সার্থক হবে? আনুষ্ঠানিকতা ও আড়ম্বরের প্রয়োজন নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহীত পদক্ষেপ ও কর্মসূচির স্থায়িত্বও জরুরি। আমি জানি, সরকার এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নমূলক বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর যাতে সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে আন্তরিক থাকতে বলি আমরা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আমি বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়নের বাইরেও তারা অবদান রাখতে পারেন। যেমন- অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সুচারুভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করা। বঙ্গবন্ধু যেমন আন্তরিকতার সঙ্গে মানুষের কথা শুনতেন এবং তার দিক থেকে সর্বোচ্চ প্রয়াস গ্রহণ করতেন, তেমনিভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যদি সাধারণ মানুষের কথা শোনেন ও ব্যবস্থা নেন, সেটা হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোত্তম উপায়। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বাঙালিকে আখ্যা দিতেন ‘দুখী মানুষ’ হিসেবে। তাদের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার জীবনের ব্রত। মুজিববর্ষে আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর শপথ গ্রহণ করতে পারি।

জাতির পিতার চিন্তা-চেতনায় সব সময় কাজ করত বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ। তিনি ছিলেন এ দেশের স্থপতি। ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তার নীতি ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তার নাম এ দেশের লাখো কোটি মানুষের অন্তরে চির অমলিন, অক্ষয় হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসড়কে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মুজিববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমরা যেমন বঙ্গবন্ধুর অবদান অক্ষয় করে রাখব, তেমনই আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির অঙ্গীকার নতুন করে শানিত করব। বঙ্গবন্ধু শত জেলজুলুম সয়েও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। একটি সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত বাংলাদেশ গঠনে আমাদের সবার অবদানই হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ঋণশোধের সামান্য প্রচেষ্টা।

চার.

প্রশ্ন হতে পারে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যে আমরা প্রজন্মান্তরে চিরঞ্জীব রাখার কথা বলছি, সেটা কীভাবে সম্ভব? আমরা স্বস্তির সঙ্গে দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন নানা ক্ষেত্রে। তার সব ভাষণের লিখিত রূপ এখন আর দুর্লভ নয়। তার অনেক ভাষণের অডিও এবং ভিডিও চিত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। কয়েক বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে আকাশবাণী বেতারে সংরক্ষিত ১৯৭২ সালে কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটির অডিও কপি উপহার দিয়েছেন। এরই মধ্যে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকেও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।

বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, সেই আত্মজীবনী তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা সেই পাণ্ডুলিপিও নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। পঁচাত্তরের মর্মন্তুদ অধ্যায়ের পর বহু বছর তার কোনো হদিস ছিল না। জাতি হিসেবে বাঙালির পরম সৌভাগ্য যে, শেষ পর্যন্ত ওই পাণ্ডুলিপি জরাজীর্ণ অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে আমরা হাতে পেয়েছি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এই অসমাপ্ত আত্মজীবনী যেন আমাদের জাতীয় জীবনকে সম্পন্ন করেছে। বঙ্গবন্ধুর নিজের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, রাজনৈতিক জীবন ও দর্শন কেবল নয়; ওই সময়ে এ অঞ্চলের অনেক ঐতিহাসিক ও সামাজিক অধ্যায় আমরা জানতে পারছি। গ্রন্থটি বহু ভাষায় অনুবাদ হয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষও জানতে পারছে বঙ্গবন্ধুকে। এরপর প্রকাশ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’। কয়েক দিন আগে প্রকাশ হয়েছে তার নিজের জবানিতে লেখা আরেকটি গ্রন্থ ‘আমার দেখা নয়াচীন’। আমরা এখান থেকেও জানতে পারছি তৎকালীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার আরেকটি অধ্যায়। পাশাপাশি পাকিস্তানি গোয়েন্দা নথিতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত তথ্য ও বিশ্নেষণ নিয়ে কয়েক খণ্ডের বই প্রকাশ হচ্ছে, তাও বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে নতুন প্রজন্মকে সহায়তা করবে।

আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখার পাশাপাশি তাকে নিয়ে অন্যদের বিশ্নেষণ এবং গবেষণা প্রকাশও জরুরি। বিশেষত ষাটের দশকে তিনি যখন একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করছেন, নতুন রাষ্ট্রের রূপরেখা নিয়ে ভাবছেন, তখনকার সময় নতুন প্রজন্মের সামনে তাদের উপযোগী করে তুলে ধরতে হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে তিনি কীভাবে গড়ে তুলছিলেন এবং ‘প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড’ বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে আরও গবেষণা হওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও রাষ্ট্র-দর্শন কেবল আমাদের অতীত সম্পর্কেই সমৃদ্ধ করবে না, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গঠনেও সহায়তা করবে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রকাশনা থেকে যেসব গ্রন্থ প্রকাশ হবে, সেগুলোতে এসব বিষয় জোর দেওয়ার আহ্বান জানাই আমি।

মো. আবদুল হামিদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি

Pin It