তানবীরা তালুকদার, প্রবাস বসবাস হলেও লেখার চাষ চলছে নিয়মিত। চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহী থাকায় মাঝে মাঝেই এই বিষয়ে লেখালিখি করেন। পুরাতন গল্প নতুন করে উপস্থাপনের যে ধারা বর্তমান কলকাতার চলচ্চিত্রে চালু হয়েছে সেই বিষয়ে লিখেছেন পাঠকদের জন্য।
তুম হোতি তো ক্যায়সা হোতা, তুম ইয়ে কেহতি, তুম ওহ ক্যাহতি, – ‘সিলসিলা’ সিনেমার বিখ্যাত এই গান গেয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন নিজেই। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সেই কালজয়ী উপন্যাসগুলো যদি আজ লেখা হতো, তাহলে কেমন হত? রবীন্দ্রনাথ চারুলতাকে কীভাবে শাড়ি পরাতেন, কোন আঙ্গিকে সাজাতেন? কিংবা ‘বৃন্দা’? রবীন্দ্রনাথ কি ‘চারুলতা’ই নাম দিতেন তার চরিত্রের নাকি চৈতি? না, সে আজ আর আমাদের জানার উপায় নেই কিন্তু ওপরের গানের থিমটির মতো কোলকাতায় বেশ ট্রেন্ড হয়েছে পুরানো উপন্যাসগুলোকে আজকের আলোকে চিত্রায়িত করার।
সিনেমাগুলো থেকে অবশ্য ধারণা করতে পারি আজ হলে উপন্যাসগুলো কেমন ভাবে লেখা হতো। ‘ভিজুয়ালাইজেশন’ চিরকালই একটি খুব শক্তিশালী মাধ্যম। নিজেদের কল্পনা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে অন্যদের কল্পনা উসকে দিতে এর জুড়ি নেই।
এই ট্রেন্ডটির প্রথম সিনেমাটি সম্ভবত ঋতুপর্ণা অভিনীত ‘চারুলতা’। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’কে আজকের প্রেক্ষাপটে চিত্রায়িত করা হয়েছে। মূল গল্পটি কিংবা ভাবটি একই শুধু বদলে গেছে নায়ক-নায়িকার সাজ পোশাক, সংলাপ, যোগ হয়েছে মোবাইল, ফেসবুক ইত্যাদি।
তবে সময়টা যেহেতু ২০১১, তাই চরিত্রগুলোও অন্যরকম। স্বামী বিক্রমের চরম উদাসীনতা থেকে মুক্তি পেতে ইন্টারনেটে নিজেকে খুঁজতে হন্যে চৈতি, তখনই প্রায় তল পাওয়ার মতো হাজির সঞ্জয়। মানে ‘অমল’। ইথারের তরঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। অগ্নিদেব চ্যাটার্জির পরিচালনা, সুদীপা মুখোপাধ্যায়ের চিত্রনাট্য, ঋতুপর্ণা, দিব্যেন্দু, অর্জুন এর অভিনয়ে এক অনবদ্য সিনেমা।
এরপর শংকরের উপন্যাস ‘চৌরঙ্গী’র আধুনিক চিত্রায়ণ সৃজিতের হাত ধরে ‘শাহজাহান রিজেন্সি’। এই ছবি আপাদমস্তক সৃজিতের ছবি। শঙ্করের গল্পের কেবল আদলটাই রয়েছে, বাকি চরিত্রদের নাম বদল করে তাঁদের পর্বগুলিকেও নিজের ছকে সাজিয়ে নিয়েছেন সৃজিত।
ছবির শুরুতেই ‘রুদ্র’ চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, এই ছবির সব চরিত্রেরই অদলবদল ঘটে গিয়েছে।
ছবির শেষের অংশটা সত্যিই অসাধারণ। ২০১৯-এর ক্রাইসিসগুলোকে চৌরঙ্গীর চরিত্রদের মুখ দিয়ে যথাযথভাবে বলানোর চেষ্টা করলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
তাৎক্ষণিকভাবে যে সংলাপটা সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে গেছে, ‘কাটা দাগ মিলিয়ে যায়, নাকি আরও একটি বড় দাগ এসে আগেরটাকে ছোট করে দেয়’।
গুমনামি সিনেমার মতো, ছোট একটি চরিত্রে, এই সিনেমাতেও সৃজিত নিজে অভিনয় করেছে। দুটো সিনেমায় অভিনয় দেখে মনে হয়েছে, সৃজিত ক্যামেরার পেছনেই অনায়াস, ক্যামেরার সামনের জায়গাটা হয়ত তার জন্যে নয়।
এই ট্রেন্ডের সম্ভবত সর্বশেষ সংযোজন হল অপর্ণা সেনের ‘ঘরে বাইরে আজ’৷ বৃন্দার চরিত্রে তুহিনা অসাধারণ। বৃন্দাকে কাঠগড়ায় তোলেননি পরিচালক। এই শতকের বৃন্দা সে! সব অর্থেই স্বাধীন। অভিনয় সাজ রুচি, সব মিলিয়ে অপর্ণার ‘বিমলা’ আর ছবির ‘বৃন্দা’ হয়ে উঠেছেন।
বৃন্দার মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন বেশ সফলভাবে পরিচালকের নির্মাণে ধরা পড়েছে। উপন্যাসের চরিত্রগুলির আধুনিকীকরণের যে প্রচেষ্টা করেছেন পরিচালক, সে কাজে তাঁকে সফলই বলা যায়।
ছবির নিখিলেশ উদারনৈতিক চিন্তাধারায় পুষ্ট, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে একা দাঁড়াতে সে ভয় পায় না। আবার জনস্বার্থে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পে সে এগিয়ে আসে সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে। সন্দীপের মতো বুলি আওড়ানো ‘ন্যাশনালিস্ট’-দের প্রতি তার প্রতিবাদী স্বর ছিল অব্যাহত।
সিনেমাপ্রেমীদের জন্যে সিনেমাগুলো ‘মাস্ট সি’। তাই স্পয়লার দিলাম না।