বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছেই; বাড়ছে সরকারের ঋণ।
গত নয় মাস ধরে টানা নামছে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি।আর চড়ছেই সরকারের ঋণের বোঝা।যাকে অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের বলছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার ব্যাংকিং খাতের ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৮৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই অংক গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে এই একই সময়ে ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া মোট ঋণের স্থিতির পরিমাণ হচ্ছে এক লাখ ৬২ হাজার ২৪১ কোটি ৬০ লাখ টাকা।যা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৭৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি।
জানুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। আর সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬৫ দশমিক ০৫ শতাংশ বেশি।
বিশ্বব্যাপী মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও কমবে বলে আশংকা করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও আহসান এইচ মনসুর।
দুজনই বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ‘তছনছ’ হয়ে যাচ্ছে।তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে।আমদানি-রপ্তানি কমছে।সবমিলিয়ে বাংলঅদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। সে অবস্থায় একদিকে যেমন ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের জন্য যথেষ্ট তহবিল থাকবে না; অন্যদিকে শিল্পদ্যোক্তাদের ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে না।
২০০৭-০৮ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “এটা খুবই উদ্বেগের যে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা মুদ্রানীতির লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম।”
“করোনাভাইরাসের কারণে এটা এখন কোথায় নেমে আসবে সেটাই চিন্তার বিষয়।”
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এমনিতেই বিনিয়োগের অবস্থা খারাপ।বেশ কিছুদিন ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কম।তার উপর ব্যাংক থেকে সরকার প্রচুর ঋণ নেওয়ায় এই প্রবাহে আরও টান পড়েছে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, তথ্য ঘেটে দেখা যায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
ওই মন্থর গতির কারণে গত বছরের ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯-২০ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ধরা হয়।
মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর ফজলে কবির বলেছিলেন, “আগের মুদ্রানীতিতে বেসরকালি খাতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও অর্জিত হয় ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। তা থেকে বাড়িয়ে এবার ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।”
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ার যে লক্ষ্য ধরেছে, বর্তমান অঙ্ক তার থেকে ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ পয়েন্ট কম।
অন্যদিকে মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে অবশ্য তা বাড়িয়ে ৫৬ শতাংশ করা হয়। কিন্তু সেটাও ছাড়িয়ে ৭৫ দশমিক ৫৫ শতাংশে উঠেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
অক্টোবরে ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ।সেপ্টেম্বরে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস জুলাইয়ে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ।
তার আগে জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ; মে মাসে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ।এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ।
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছে।